শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজিরবিহীন রেকর্ড

ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণের বেশি

জিন্নাতুন নূর

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজিরবিহীন রেকর্ড

এক দশক আগেও ‘লোডশেডিং’-এর অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল দেশের মানুষ। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ তখন একধরনের লুকোচুরি খেলত। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ আসত তো বেশি সময় স্থায়ী হতো না। তবে এক দশকের ব্যবধানে দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির নজিরবিহীন পরিবর্তন হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গেল ১৯ মার্চ। এদিন সন্ধ্যায় দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায় এবং প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে মোট ১০ হাজার ৮৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের নয় বছরে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে একের পর এক নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে বিদ্যুৎ খাতেরও বেশ উন্নতি হয়েছে। এ নয় বছরে বিদ্যুৎ খাতে গ্রাহকসংখ্যা একদিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমন বৃদ্ধি পেয়েছে বিদ্যুতের সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও। অন্যদিকে এ সময়ে কমেছে সিস্টেম লসের হারও। বৃদ্ধি পেয়েছে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের হার। সর্বোপরি আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পর গত নয় বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৪৬ মেগাওয়াটে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের যুগোপযোগী বাস্তবসম্মত টেকসই পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণের ফলেই বিদ্যুৎ খাতে এ নজিরবিহীন উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের আগে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযোজিত হতো। এমনকি ২০০৯ সালের আগে দেশে উৎপাদন হতো সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যদিও গ্রীষ্মকালে সে সময় ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। কিন্তু এর বিপরীতে সরবরাহ ছিল মাত্র ৩ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য বেশি হওয়ায় তখন সারা দেশে ব্যাপক লোডশেডিং হতো। এতে ব্যাহত হতো শিল্প ও কৃষির উৎপাদন। বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে চলতি বছরের ১৯ মার্চ পর্যন্ত বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক সাফল্যের একটি পরিসংখ্যান দেওয়া আছে। গত নয় বছরের (২০০৯-১৮) পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা ১১৯টি। যেখানে ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৭টি। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট, সেখানে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ১৬ হাজার ৪৬ মেগাওয়াট (ক্যাপটিভসহ) দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ নয় বছরে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে ১১ হাজার ১০৪ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে দেশে গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা (এমভিএ) ছিল ১৫ হাজার ৮৭০। আর ২০১৮ সালে তা হয় ৩০ হাজার ৯৯৩। ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশের বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ হচ্ছে ৬৬০ মেগাওয়াট। ২০০৯-এ বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ছিল ৪৭ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯০ শতাংশে। এ ছাড়া ২০০৯ সালে বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা যেখানে ছিল ১ কোটি ৮ লাখ, তা ২০১৮-তে এসে দাঁড়ায় ২ কোটি ৮২ লাখে। আর নয় বছরে সেচ সংযোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২ লাখ ৩৪ হাজার থেকে হয় ৩ লাখ ৬১ হাজার। এমনকি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশের সব এলাকা শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ।

বিদ্যুৎ বিভাগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই অর্থবছরে বিদ্যুতের সামগ্রিক সিস্টেম লস ১৩.১০ শতাংশ থেকে ০.৯১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ১২.১৯ শতাংশে পৌঁছায়। অথচ ২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৬.৮৫ শতাংশ। আর দেশব্যাপী মোট ১০ হাজার ৬৮০ সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন তৈরি হয়েছে এবং বিতরণ লাইন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ লাখ ৩৪ হাজার কিলোমিটার।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, ২০০৯ সালের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বিদু্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার তাত্ক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ পরিকল্পনার আওতায় ২০২১ সালের মধ্যে ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ সুবিধা নিশ্চিত করতে উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ চলছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল পর্বের কাজ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে চলছে পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজও। তালিকায় আছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণকাজও। বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা আশা করছেন ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বৃহৎ এ প্রকল্পগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর এ চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোট ৭ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ সরকারের দুই মেয়াদে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণের বেশি। তিনি বলেন, গ্রীষ্মে এবার লোডশেডিং নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। গ্রীষ্মে ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। আশা করছি এবার লোডশেডিং বেশি হবে না। এ ছাড়া চলতি বছর আমরা ৩ হাজার মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে যাচ্ছি। বিগত বছরে এর পরিমাণ ছিল মাত্র ৯০০ মেগাওয়াট। প্রতি মাসে এখন সাড়ে ৩ লাখ গ্রাহককে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে অর্থনীতির গতি বাড়ছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০২০-২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হলে আমাদের ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকতে হবে। আর এ সময়ের মধ্যে পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোও পর্যায়ক্রমে বন্ধ হতে শুরু করবে। আশা করছি বিশ্বব্যাংক এবং জি টু জির বড় প্রকল্পগুলো এবং পায়রা ও মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো উৎপাদনে এলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।’

উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৮১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৮৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১ হাজার ৬৫৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ১১৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হয়েছে। বর্তমানে মোট ১৩ হাজার ৭৭১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন। আর এ কেন্দ্রগুলো ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এ ছাড়া ৫ হাজার ৯২ মেগাওয়াটের ৩০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন। যেগুলো ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চালু হবে। এ ছাড়া আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে ভারতের তিনটি স্থান থেকে ২ হাজার ৩৩৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ আমদানি কার্যক্রম অব্যাহত আছে; যা ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শুরু হবে।

সর্বশেষ খবর