শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

শহরে সিক্রেট গ্যাং

মির্জা মেহেদী তমাল

শহরে সিক্রেট গ্যাং

উত্তরা থানা পুলিশের একটি দল একজন ব্যবসায়ীর বাসায় অভিযান চালায়। তারা ব্যবসায়ীর ছেলেকে ধরে নিয়ে আসতেই তাদের এই অভিযান। কিন্তু ছেলেটির বাবা পুলিশকে বলে, অফিসার, আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। আমার ছেলে স্কুলে পড়ে। ওর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তবে কেন আমার ছেলেকে ধরতে এসেছেন? পুলিশের জবাব, স্যার, আমাদের কোনো ভুল হচ্ছে না। আমরা আপনার ছেলেকেই ধরতে এসেছি। আপনার স্কুল পড়ুয়া ছেলে খুনের মামলার আসামি। আমরা যতদূর তদন্তে জেনেছি, খুনের সঙ্গে আপনার ছেলে সরাসরি জড়িত।

পুলিশের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়েন ব্যবসায়ী। ভেতরের ঘর থেকে পুলিশের সামনে ছুটে আসেন ব্যবসায়ীর স্ত্রী। তিনি কান্না করতে থাকেন। পুলিশের উদ্দেশে বলেন, আমার বাচ্চা ছেলে সম্পর্কে এমন কথা কেন বলছেন। আমার ছেলে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে স্কুল-কোচিং ইত্যাদি নিয়ে থাকে। তারপর বিকেলে বাসায় এসে কিছুক্ষণ খেলাধুলা করতে বের হয় এবং সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে আসে। এই সময়ের মধ্যে বাজে কাজ তাও খুনখারাবির মতো কোনো কাজ করতে পারে না। আমাদের মাথায় আসে না। পুলিশ বলে, আপনাদের ছেলে একটি গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত। এক পর্যায়ে পুলিশ ওই বাসা থেকে উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান খুনের আসামি ওই ছেলেকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়।

রাজধানীর উত্তরা শুধু নয়, শহরের বিভিন্ন এলাকায় পশ্চিমা সংস্কৃতির ধাঁচে গড়ে উঠেছে কিশোর বয়সী ছেলেদের সিক্রেট গ্যাং গ্রুপ। কিন্তু অভিভাবকরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে। তাদের সন্তানরা স্কুলে পড়াশোনা আর মাঠে খেলাধুলার বাইরে অন্য কিছু নিয়েও মেতে ছিল, তা মানতেও পারছেন না তারা। কিন্তু পুলিশ সম্প্রতি উত্তরায় কিশোর আদনান হত্যার দায়ে অপরাধীদের ধরতে বাসা-বাড়িতে গেলে অভিভাবকরা বিস্মিত হন। তখন শুনলেন তাদের সন্তানদের স্কুলের পড়াশোনা এবং খেলার মাঠের খেলাধুলার বাইরেও একটি জগৎ আছে। যেখানে তারা গ্যাং গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে ক্যাডারবাহিনী গড়ে তুলেছে। হয়ে উঠছে দুর্ধর্ষ এবং এরই মধ্যে তাদের দ্বন্দ্বে মারামারি, কাটাকাটি এমনকি খুনোখুনি পর্যন্ত ঘটে গেছে।

সর্বশেষ গত ২০ মার্চ ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে নাবিল নামের এক স্কুলছাত্রকে উত্তরায় ছুরিকাঘাত করে জীবন ঢালী নামের আরেক কিশোর। জানা যায়, জীবন ঢালী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। এ বিষয়ে উত্তরার পশ্চিম থানায় মামলা হওয়ার পর জীবনের পরিবার তাকে থানায় নিয়ে পুলিশের হেফাজতে দেয়। তবে গত তিন দিন আগে জীবন আদালত থেকে জামিন পায় বলে জানান উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী হোসেন। তিনি বলেন, জীবনকে তার পরিবার থানায় নিয়ে এসেছিল। তারপর আমরা আইনি ব্যবস্থা নিয়ে আদালতে পাঠালে আদালত তাকে জামিন দেয়। খুনের মামলার আসামি হয়েছে— এমন এক কিশোরের বাবা পুলিশকে বলেন, আমাদের উত্তরা এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন গ্যাং, গ্রুপের নামে দেয়াল লিখন দেখি। কিন্তু কারা তা করে আমরা জানতাম না। শুধু বুঝতাম এলাকায় বখাটেদের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। কিন্তু সেইসব দলে যে আমাদের স্কুলপড়ুয়া সন্তানরা জড়িয়ে গেছে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবনায় আসেনি।

‘গ্যাং কালচারের’ নামে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কিশোরদের একটা অংশ। বিভিন্ন গ্যাং নামে সক্রিয় এসব কিশোর শুরুতে মূলত ‘পার্টি’ করা, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালানো ও রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার কাজে যুক্ত ছিল। বছর খানেক ধরে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িত হয়েছে, যার সর্বশেষ শিকার উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির। এসব কিশোর এতটাই বেপরোয়া যে হত্যার জন্য বের হওয়ার আগে তারা ফেসবুকে গ্রুপ ছবি পোস্ট করে যায়। ছবিতে তাদের সবাইকে নীল রঙের পোশাকে দেখা গেছে। কারও কারও হাতে ছিল হকিস্টিক। আদনানের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর এক কিশোর পাল্টা স্ট্যাটাস দিয়েছে, ‘ভাই তোর খুনিগো বাইর কইরা জবাই দিমু’। এসব কিশোর অপরাধী ‘গ্যাংয়ের’ ব্যাপারে তাদের অভিভাবক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবাই ছিলেন উদাসীন।

জানা গেছে, সাধারণত ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সের কিশোররা এসব গ্রুপ গড়ে তোলে উত্তরায়। এর ঢেউ লাগে শহরের সর্বত্র। সাধারণ শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিং, ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত এসব গ্রুপের সদস্যরা। আধিপত্য বজায় রাখতে প্রায়ই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আদনান হত্যাকাণ্ডের পর তার বাবার দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার করা হয় সাদাফ জাকির ও নাসির আলম ডন নামে দুজন গ্যাং সদস্যকে। মেহেরাব হোসেন নামে আরেক গ্যাং সদস্যকেও আটক করা হয়। মামলায় শুরুতে ‘অজ্ঞাতনামা’ হিসেবে ছিল মেহেরাব।

উত্তরার ‘গ্যাং কালচার’ অবশ্য নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর আগেই উত্তরা ও আশপাশের এলাকায় গড়ে ওঠে ৩০টির মতো ছোট-বড় গ্যাং। এগুলোর মধ্যে কাঁকড়া গ্রুপ, জি ইউনিট গ্রুপ, ব্ল্যাক রোজ গ্রুপ, রনো গ্রুপ, কে নাইট গ্রুপ, ফিফটিন গ্রুপ, ডিসকো বয়েজ গ্রুপ, নাইনস্টার গ্রুপ, নাইন এম এম বয়েজ গ্রুপ, পোটলা বাবু গ্রুপ, সুজন গ্রুপ, আলতাফ গ্রুপ, ক্যাসল বয়েজ গ্রুপ ও ভাইপার গ্রুপ সক্রিয় ছিল। ২০১৫ সালে এই গ্যাংগুলো সংগঠিত হয়ে বৃহৎ আকারে ‘ফিফটিন গ্রুপ’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। পরে আবার এই ফিফটিন গ্রুপ ভেঙে তৈরি হয় তিনটি গ্রুপ। ১৮ জানুয়ারি তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় এমন কিশোর গ্যাংয়ের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে আবদুল আজিজ নামে এক কিশোর। যার হত্যাকারীরাও অনুরূপ কিশোর এবং কিশোর গ্যাং গ্রুপের সঙ্গেই জড়িত।

ধানমন্ডির মোহাম্মদ হোসেন নামে এক অভিভাবক বলেন, আমার ছেলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। আমিও চিন্তিত। কারণ, সেও তার বন্ধুদের সঙ্গে যায়, সময় কাটায়। কিন্তু কখন কী হয় সে নিয়ে এখন বেশ চিন্তিত আছি। শুধু রাজধানী নয়, চট্টগ্রাম নগরের ১৬ থানা এলাকায় শতাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপ গঠনে নেপথ্য ভূমিকা পালন করছেন ছাত্র সংগঠনের তথাকথিত নেতারা। কিশোর গ্যাং গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে তাদের গডফাদাররা ফোন করে বসেন। তাই পুলিশ এত দিন গ্যাং গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে সংশয়ে থাকে। পুলিশ জানায়, এসব কিশোর একে অপরকে শক্তি দেখাত। এ জন্য তারা গ্যাং গ্রুপ তৈরি করে এবং তাদের সদস্য বাড়ায়। তারা প্রায়ই উচ্চ গতিতে মোটরসাইকেল চালাত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে নিজেদের গ্রুপের শক্তি প্রদর্শন করতে এক দল অন্য দলের সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এসব গ্যাং গ্রুপের কিশোররা হকিস্টিক, ক্রিকেট স্টাম্প, ব্যাট ছাড়াও ধারালো ছোট ছোট ছুরি ব্যবহার করে। এসব গ্রুপ দেয়ালে দেয়ালে বিভিন্ন কারুকার্যের চিত্রাঙ্কন করে তাদের প্রচারণা চালাত। কিন্তু স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হবে এগুলো কোনো পণ্যের বা দোকানের বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহূত হয়েছে। যা ছিল অসচেতন অভিভাবকদের ভুল। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ছেলেদের কার্যক্রম সম্পর্কে অভিভাবকদের কোনো ধারণাই নেই। কিশোরদের এসব গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের অধিকাংশই সমাজের উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের সন্তান। অভিযোগ আছে, তারা বাবার টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাদকও গ্রহণ করে। কখনো কখনো টাকার সংস্থান করতে গিয়ে তারা শেষ পর্যন্ত ছিনতাইয়ের  ঘটনায় যুক্ত হয়। তিনি বলেন, এমনকি অভিভাবকরা এটাও জানেন না তাদের সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে এবং কার সঙ্গে তারা ওঠাবসা করছে। এমনকি অভিভাবকরা এই অল্প বয়সে সন্তানদের মোটরসাইকেল দিয়েছে। এই পুলিশ কর্মকর্তা অভিভাবকদের দায়ী করে বলেন, বাবারা তাদের সন্তানদের দেখাশোনা না করার জন্য দায়ী নয় কি? একা পুলিশের পক্ষে এই ধরনের অপরাধ নিবারণ করা কতটুকু সম্ভব, যদি অভিভাবকরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা এবং সমাজে আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে এই ধরনের ক্যাডার বাহিনী তৈরি হয়। এ জন্য সামাজিক ও পরিবারিক বন্ধন এবং সংস্কৃতির মোকাবেলার ওপর জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, এই টিনএজাররা পশ্চিমা সংস্কৃতি অনুসরণ এবং ইন্টারনেটের মতো দ্রুততম যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছেন। কিন্তু আমরা আমাদের শিশুদের খারাপ প্রভাব মোকাবিলা করতে শিখাতে পারছি না। তিনি এ বিষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর