বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বেপরোয়া গণপরিবহন রাজধানীতে মৃত্যুদূত

নিজামুল হক বিপুল

রাজধানীর সড়কগুলোয় চলাচলকারী গণপরিবহন এখন রীতিমতো মৃত্যুদূত। চালকের বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় গাড়ির চাপায় ও দুই গাড়ির মাঝখানে পড়ে প্রায়ই মারা যাচ্ছেন সাধারণ যাত্রীদের কেউ না কেউ। কিংবা এসব যানবাহনে চলাচল করতে রাস্তায় বের হওয়া সাধারণ মানুষের অঙ্গহানি ঘটছে।

সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই গাড়ির রেষারেষিতে হাত হারিয়েছেন সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন গণপরিবহনের এমন নোংরা ও বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের প্রাণহানি কিংবা অঙ্গহানি ঘটলেও এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ সংশ্লিষ্টরা। রাস্তাকে মানুষের জন্য নিরাপদ করে তোলার ক্ষেত্রে কারও কোনো ভূমিকাই দেখা যাচ্ছে না।

রাজধানীর আশপাশের টঙ্গী, গাজীপুর, কামারপাড়া, আশুলিয়া, সাভার, ধামরাই, নবীনগর, নগরীর মিরপুর, মাজার রোড, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, চিড়িয়াখানা, মিরপুর ১, ২, ১০, কালশী, কচুক্ষেত বাজার, উত্তরা, আজমপুর থেকে প্রতিদিন শত শত গণপরিবহন ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার হয়ে প্রেস ক্লাব, মতিঝিল, আজিমপুর, সায়েদাবাদ, শনিরআখড়া, চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড পর্যন্ত যাওয়া-আসা করে। একই ভাবে প্রগতি সরণি হয়ে বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, কাকরাইল, নয়াপল্টন, রাজারবাগ হয়ে চিটাগাং রোড শনিরআখড়া, সায়েদাবাদে যাতায়াত করে। মহাখালী, নাবিস্কো হয়েও চলাচল করে বেশকিছু গণপরিবহন। এর পাশাপাশি নগরীর বিভিন্ন সড়কে চলাচল করা লেগুনাও নগরীর বিপজ্জনক যানবাহনগুলোর অন্যতম।

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলাচলকারী নগর পরিবহনই হচ্ছে নগরীর সাধারণ মানুষের নিত্য যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। ঘুম থেকে উঠে সাতসকালে কর্মস্থলের দিকে ছুটে যাওয়া, আবার কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার ক্ষেত্রে কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষের কাছে এই গণপরিবহনই একমাত্র ভরসা। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, শীত— সব ক্ষেত্রেই গণপরিবহন একমাত্র বিকল্প। আর এই ‘ভরসা’ই সাধারণ ও কর্মজীবী মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

রাজধানীতে বিভিন্ন রুটে গণরিবহন হিসেবে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বাস-মিনিবাস চলাচল করছে। এর বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন। আর কিছু আছে বিআরটিসির তত্ত্বাবধানে। ব্যক্তিমালিকানাধীন গণপরিবহনগুলোতেই অরাজকতা বেশি। অদক্ষ, অপ্রাপ্তবয়স্ক, নেশাখোর চালকরা ঘুম থেকে উঠেই গণপরিবহন নিয়ে রাজধানীর রাস্তায় নামছে। তারপর যাত্রী ওঠানোর প্রতিযোগিতায় নেমে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে কিংবা পঙ্গু করে দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় যেখানে বাস স্টপেজই নেই, সেসব স্থানে গাড়িগুলো রাস্তার ওপর থেকেই যাত্রী ওঠানোর জন্য বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় প্রতিনিয়ত। আর তখনই ঘটে দুর্ঘটনা। রাজধানীর ব্যস্ততম ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, সোনারগাঁও ক্রসিং, বাংলামোটর, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, মহাখালী রেল ক্রসিং, মহাখালী বাস টার্মিনাল, বনানী ১১ নম্বর, চেয়ারম্যানবাড়ী, বনানী ক্রসিং, সাতরাস্তা মোড়, আসাদগেট, শ্যামলী, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, কলাবাগান, শাহবাগ মোড়, প্রগতি সরণির কুড়িল বিশ্বরোড, শাহজাদপুর, নতুনবাজার, বাড্ডা, মধ্য বাড্ডা, রামপুরা ব্রিজ, আবুল হোটেল, কাকরাইল ক্রসিংসহ এ রকম গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত সড়কে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানো করে বাস-মিনিবাসগুলো। অধিকাংশ সময় নগরীর ব্যস্ততম এসব স্পটে চলন্ত গাড়ি থেকে যাত্রী ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় গাড়ির হেল্পার। আবার একই কায়দায় টান দিয়ে গাড়িতে ওঠানো হয় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের। ফলে দুর্ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে ঢাকার রাস্তায়। অথচ নগরীর প্রতিটি সড়কে নির্ধারিত বাস স্টপেজ থাকার পরও সেখানে কোনো গণপরিবহনকেই থামতে দেখা যায় না। শুধু তাই নয়, বাস-মিনিবাসগুলো রাস্তায় বেপরোয়া প্রতিযোগিতা করে একে অন্যকে টেক্কা দিতে গিয়ে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে নিয়মিতই চাপা দিচ্ছে— এমন দৃশ্য প্রায়ই চোখে পড়ে। এসব ঘটনার কোনো কোনোটিতে মামলা হলেও সেগুলো পরবর্তীতে মিটমাট হয়ে যায় দুই পক্ষের ক্ষতিপূরণ আদায়ের মধ্য দিয়ে। ফলে বাস-মিনিবাসের বেপরোয়া চালকদের কোনোরকম শাস্তিই পেতে হয় না। নগরীর সড়কগুলোর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। যেমন যেসব মোড়ে ট্রাফিক সার্জেন্টরা দায়িত্ব পালন করেন, সেসব স্থানে বাস-মিনিবাস রাস্তার মধ্যে দাঁড়ানোর সাহস পায় না। কিন্তু যখনই চালকরা দেখতে পান সার্জেন্ট নেই, তখনই তীব্র প্রতিযোগিতা করে সড়কের মধ্যেই বাস দাঁড় করিয়ে দেন। তাতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কে গণপরিবহনের এ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক (দক্ষিণ) বিভাগের যুগ্ম-কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ঢাকা শহরে মুষ্টিমেয় বাস স্টপেজ ছাড়া অধিকাংশ স্থানেই স্টপেজ নেই। আমরা দুই সিটি করপোরেশনকে শতাধিক বাস স্টপেজ নির্মাণের জন্য নকশা করে চিঠি দিয়েছি। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে কিছু বাস স্টপেজ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে দুই সিটি করপোরেশন। তিনি বলেন, আমরা যদি বাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি অর্থাৎ নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া গাড়ি যেমন দাঁড় করাতে পারবে না, তেমনি এক স্টপেজ ছেড়ে যাওয়ার সময় গাড়ি গেটলক করতে হবে এবং পরবর্তী স্টপেজের আগে কোনো যাত্রী ওঠাতে বা নামাতে পারবে না— তখন যাত্রীরাও রাস্তায় যত্রতত্র দাঁড়িয়ে গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করবেন না। তিনি রাজীবের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ রকম একটি নির্মম ঘটনার পর আমাদের আরও সতর্ক ও সচেতন হতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর