বৃহস্পতিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

চোখ মেলেই দেখেন হাতটা নেই

রাজীবের চিকিৎসা ব্যয় দিতে হবে বাস মালিকদের, দুই চালক গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক

চোখ মেলেই দেখেন হাতটা নেই

দুই বাসের মাঝে পড়ে হাত হারিয়েছেন রাজীব। হাসপাতালে গতকাল —বাংলাদেশ প্রতিদিন

জ্ঞান ফেরার পর চোখ মেলে তাকান রাজীব হোসেন। তবে চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। এদিক-ওদিক মাথা ঘোরানোর চেষ্টা করেন। বাঁ হাত নাড়ছিলেন। এর পরই কী মনে করে ডান দিকে মাথা ঘুরিয়ে ডান হাতের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বাঁ হাত দিয়ে তিনি তার ডান হাতটি খুঁজছিলেন। কিন্তু তার তো হাত নেই। তিনি চোখ মেলেই দেখতে পেলেন ডান হাতটি তার নেই। মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারান তিতুমীর কলেজের স্নাতকের ছাত্র রাজীব হোসেন। তাকে প্রথমে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টাকার অভাবে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাজীবের হাত হারানোর মর্মান্তিক ঘটনার পর সারা দেশে মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শমরিতা হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) চিকিৎসক মো. হোসেন বলেন, রাজীবের জ্ঞান আছে, কিন্তু একটা ঘোরের মধ্য রয়েছেন। তার সারা শরীরে ব্যথা। ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে তাকে এই হাসপাতালে আনা হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত তার অস্ত্রোপচার করা হয়। তার বাহুর নিচ থেকে পুরোটাই কাটা পড়েছে। ক্ষতগুলো ঠিক করা হয়েছে। এখন তার অবস্থা স্থিতিশীল। এ আঘাত ছাড়া আর কোনো বড় আঘাত নেই। মো. হোসেন বলেন, রাজীবের পরিবার জানিয়েছে, এখানে চিকিৎসার ব্যয় বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে পরিবার। রাজীব হোসেনের খালা জাহানারা বেগম ছিলেন হাসপাতালে। তিনি বলেন, ওর জ্ঞান এখনো পুরোপুরি ফেরেনি। মাঝেমধ্যে শরীর নাড়াচ্ছে। বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটা খুঁজছে। জাহানারা বেগম বলেন, ‘তার চিকিৎসার খরচ জোগানোর মতো সাধ্য আমাদের নেই। এখন পর্যন্ত ওষুধের দামসহ দেড় লাখ টাকা বিল হয়েছে। এর মধ্যে ওষুধের খরচ ছিল ১৭ হাজার। আমরা ৫০ হাজার টাকা দিতে পেরেছি। বাকি টাকা পরে দেব— এমন আবেদন লিখিতভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছি। এখন ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি।’ রাজীবের মা-বাবা নেই। স্বজনদের সহৃদয় সহযোগিতায় কষ্টেসৃষ্টে পড়াশোনা চালাচ্ছিলেন। থাকেন যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগের একটি মেসে।

হাসপাতালে রাজীবের মামা মোহাম্মদ জাহিদ গতকাল দুপুরে বলেন, এখন পর্যন্ত পাঁচ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। তিনি সরকারসহ সবার কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছেন। সুস্থ হলে প্রধানমন্ত্রী যেন রাজীবকে একটি চাকরি দেন এমন আবেদন করেন তিনি।

মঙ্গলবার বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের (বাণিজ্য) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন (২১)। হাতটি বেরিয়েছিল সামান্য বাইরে। হঠাৎই পেছন থেকে একটি বাস বিআরটিসির বাসটি পেরিয়ে যাওয়ার বা ওভারটেক করার জন্য বাঁ দিক ঘেঁষে পড়ে। দুই বাসের প্রবল চাপে রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দু-তিন জন পথচারী দ্রুত তাকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু চিকিৎসকরা চেষ্টা করেও বিচ্ছিন্ন সেই হাতটি রাজীবের শরীরে আর জুড়ে দিতে পারেননি।

চিকিৎসা ব্যয় দিতে হবে বাস মালিকদের : রাজীব হোসেনের চিকিৎসা ব্যয় বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনকে বহন করতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে রাজীব হোসেনকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছে আদালত। গতকাল এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদেশে চার সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক পরিবহন সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, ডিএমপি কমিশনারসহ আট বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল গতকাল হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন।

দুই বাসচালক গ্রেফতার : গতকাল এক  প্রেস বার্তায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেসন্স বিভাগ জানিয়েছে, রাজীব হোসেনের হাত হারানোর ঘটনায় উভয় বাসের চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন- বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন বাসের চালক মো. খোরশেদ।

সর্বশেষ খবর