শুক্রবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে তিস্তার পানি

রবিবার ঢাকায় আসছেন ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব

ঝর্ণা মনি

রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে তিস্তার পানি

রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে তিস্তার পানি। বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলেও ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের মতবিরোধ আর রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এ ক্ষেত্রে আগ্রহী। কিন্তু কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলোকে বোঝাতে পারছেন না তিনি। ফলে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে তিস্তার ন্যায্য হিস্সা থেকে। তবে বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে তিস্তা চুক্তির একটি সম্মানজনক সুরাহার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তিস্তার খসড়া চুক্তি অনুযায়ী, শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তায় প্রবাহিত পানির পরিমাণ হিসাব করে দুই দেশের মধ্যে বণ্টন হবে। ৪৬০ কিউসেক হারে সঞ্চয় রেখে বাকি ৫২ শতাংশ নেবে ভারত, ৪৮ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ। এ শর্তেই ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পানির অভাব ঘটে মূলত শুকনো মৌসুমে। তখন নদীতে প্রতি সেকেন্ডে পানি থাকে ২০০ কিউবিক ফুট। আর বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য প্রয়োজন প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ কিউবিক ফুট। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও যৌথ নদী কমিশনের তথ্যানুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮ হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত উত্তর সিকিমের চোলামু লেকে তিস্তার জন্ম। পরে রাম্মাম আর রাঙ্গিতের মিলিত ধারা তিস্তায় পতিত হয়েছে। তিস্তা পুরো সিকিমের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দার্জিলিংয়ের তিস্তাবাজার দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে। ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির গজলডোবায় ভারত তিস্তা নদীর ওপরই একটি বাঁধ নির্মাণের কাজে হাত দেয়। ভারত তার আন্তনদী সংযোগ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিস্তার পানি গজলডোবা থেকে প্রত্যাহার করে বেশ কয়েকটি খালের মাধ্যমে মহানন্দার দিকে নিয়ে যায়। শুরুতে ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের পরিকল্পনা করলেও বর্তমানে ১ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় নিয়ে যায়।

বাংলাদেশের লালমনিরহাটের দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৮ সালে। এ প্রকল্প থেকে ১২ উপজেলার ৬ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই প্রবাহ কমে ৫০০ থেকে ১ হাজার কিউসেকে নেমে আসায় বাংলাদেশের সেচ প্রকল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে। এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা সিকিমে গড়ে ওঠা মুড়ি-মুড়কির মতো অসংখ্য পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পকেই দায়ী করেছেন। তাদের দাবি, সিকিম এভাবে এলোপাতাড়ি বাঁধ দেওয়ায় শুকনো মৌসুমে তিস্তায় পানির সংকট হচ্ছে। আর বর্ষায় সিকিম বাঁধ বাঁচাতে পানি ছাড়লে ভেসে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা।

অথচ আন্তসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন, বন্যা পূর্বাভাসসংক্রান্ত তথ্য বিনিময়, সীমান্ত এলাকার তীররক্ষার জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে গঠিত হয় যৌথ নদী কমিশন। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও তিস্তা নিয়ে হতাশায় রয়েছে বাংলাদেশ। এর কারণ হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খসড়া চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি। কিন্তু ভারতের ক্ষমতার রাজনীতির কারণে চুক্তিটি আটকে আছে। তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জি চাচ্ছেন বিজেপিবিরোধী জোট। আবার কংগ্রেসও চায় বিজেপিবিরোধী জোট। এসব রাজনৈতিক খেলার কারণেই অনুস্বাক্ষর হয়ে যাওয়ার পরও আটকে আছে তিস্তা চুক্তি।

শিগগিরই তিস্তার জট খুলতে যাচ্ছে এমনটি মনে করেন সাবেক কূটনীতিক মোহাম্মদ জমির। তিনি বলেন, ছিটমহল বিনিময়ের মতো জটিল কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ হয়েছে। এর ফলে ৬৮ বছর ধরে আটকে থাকা স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ায় সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়েছে। আগামী রবিবার ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিজয় কেশব গোখলে ঢাকায় আসবেন। আশা করছি, তার সফরে এ ইস্যুটিও আলোচনায় থাকবে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. কাউসার আহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুই দেশের সরকারপ্রধানই আন্তরিক। কিন্তু ভারতের সরকারপ্রধান হয়তো কোনো কারণে তার রাজ্যপ্রধানদের বোঝাতে পারছেন না। তবে আগামী সংসদ নির্বাচনের আগেই আমরা একটা ইতিবাচক ফল পাব বলে বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে। কারণ, ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। তারা আমাদের জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশাকে বিফল করবে না। তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশাবাদী যৌথ নদী কমিশন। গঙ্গার পানি চুক্তির অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, মনু, মুহুরী, খোয়াই ও গোমতী নদ-নদীর পানি বণ্টনের জন্য ১৯৯৭ সালে কমিশনের ৩২তম সভায় যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়। কমিশনের সদস্য প্রকৌশলী মো. মোফাজ্জল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কমিশনের মাইলস্টোন হচ্ছে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। গঙ্গা চুক্তির সর্বশেষ বৈঠক গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী মাসে এ বিষয়ে ভারতে আরেকটি সভা হবে। তিস্তা চুক্তি শিগগিরই হবে। আমরা আশাবাদী। কারণ, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন পদক্ষেপ ভারত নেবে না। তিনি জানান, মহানন্দা, করতোয়া, সুরমা, ধরলা, পুনর্ভবা, ফেনী, খোয়াই, আত্রাই, নাগর, কুলিক নদ-নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ করছে কমিশন। আগাম বন্যার ক্ষেত্রে অনেক সময় তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করে ভারত। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ১৫ মে থেকে ১৫ অক্টোবরের মধ্যে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদ-নদীর বন্যাসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করে। খরস্রোতা নদ-নদীগুলোর তথ্য-উপাত্ত দেয় ১ এপ্রিল থেকেই। এর ভিত্তিতেই বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ১২০ ঘণ্টা আগে বন্যা পূর্বাভাস দিতে পারে। এর ফলে আমাদের ক্ষয়ক্ষতি কমছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর