মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

রাতের ক্যাম্পাসে যা হয়েছিল

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

কোটা সংস্কারের দাবিতে রবিবার রাতে শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপের পর আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাদের একটি অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে চলে যায়। অন্যরা চারুকলা অনুষদ, বঙ্গবন্ধু হাসপাতালসহ শাহবাগের আশপাশে আশ্রয় নেয়। পরে তারা টিএসসির রাজু ভাস্কর্যে জমায়েত হয়। এ সময় তারা কোটা সংস্কারের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। আবারও সেখানে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ে। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এভাবে থেমে থেমে চলে সংঘর্ষ। এরপর রাতভর আন্দোলন-কারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের দুই শতাধিক আহত হয়। তাদের ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের অর্ধশতাধিক গ্রেফতার করা হয়। পরে রাত ১২টার দিকে শাহবাগে যান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের ব্যাপারে অবগত আছেন। প্রধানমন্ত্রী দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সকালে বসার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তার কথায় আন্দোলনকারীরা থামেনি। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় তাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে। রাজু ভাস্কর্য থেকে জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যেই রাত ১২টার দিকে পুলিশের গুলিতে এক আন্দোলনকারীর মৃত্যুর গুজবে আবারও উত্তেজিত হয়ে উঠে আন্দোলনকারীরা। এ সময় ঢাবির বিভিন্ন হল থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দলে দলে আন্দোলনে যোগ দেয়। এ ছাড়া ছাত্রী হলগুলোর গেট ভেঙে পাঁচশতাধিক ছাত্রী ঢাবির ভিসি চত্বরে অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। আরেকটি পক্ষ ভিসি চত্বরে অবস্থান নেয়।

ঢাবি উপাচার্যের বাসভবনে তাণ্ডব : এদিকে ভিসি চত্বরে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাসে তাদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করতে থাকে। একপর্যায়ে রাত পৌনে একটার দিকে তারা ভবনের গেটে রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এ ছাড়া ভবনের দেয়ালের কাঁটাতার ছিঁড়ে ফেলে। পরে দেয়াল টপকে কিছু আন্দোলনকারী বাসভবনের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারা রড দিয়ে গেটের দুইটি তালা ভেঙে ফেলে। এ সময় মুখে কাপড় বেঁধে দুই শতাধিক আন্দোলনকারী ভবনের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারা প্রথমে সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করে। এরপর দরজা ভেঙে বাসভবনের ভিতরে ঢুকে অতিথি কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিলসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ভাঙচুর করে। উপাচার্যের বাসভবন কার্যালয়ে ঢুকে তারা সিসি টিভির মনিটর, হার্ডডিস্ক ভেঙে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এরপর তারা ভবনের নিচতলা থেকে দুই তলায় যায়। সেখানে প্রথমে তারা দরজা ও জানালার কাচ ভাঙচুর করে। এ সময় উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান সেখানে ছিলেন। উপাচার্য সিঁড়িতে এলে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ তখন উপাচার্যকে রড ও লাঠিসোঁটা দিয়ে ঘিরে ধরে। তারা উপাচার্যকে হেনস্তা করে এবং মারতে উদ্যত হয়। তখন সেখানে সাংবাদিকরা উপাচার্যকে ঘিরে মানবপ্রাচীর তৈরি করে। উপাচার্যকে কয়েক দফা আক্রমণের চেষ্টা থেকে রক্ষা করে নিরাপদে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে যায় তারা। এ সময় আরেকটি অংশ উপাচার্যের বেডরুম থেকে শুরু করে সব রুমের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। ভাঙচুর শেষে আন্দোলনকারীরা টাকা-পয়সাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র লুট করে। এ সময় উপাচার্যের স্ত্রী ও দুই সন্তান একটি কক্ষে আশ্রয় নেয়। এ ছাড়া ভবনের ভিতরে থাকা কর্মচারীরাও টয়লেটসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে চলে তাণ্ডব। এ সময় দুইটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া গ্যারেজে থাকা দুইটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। উপাচার্যের বাসভবনে হামলার সময় ফুলার রোডে মুনীর চৌধুরী ভবনের গ্যারেজে রাখা চারটি গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগের দুই নেতার মোটরসাইকেলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হামলার সময় ভবনের ভিতরে ছিলেন প্রধান নিরাপত্তা প্রহরী হাসান আলী। তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে বাসভবনে কর্মরত আছি। এত ভয়ঙ্কর হামলার ঘটনা কখনো দেখিনি। তাণ্ডবকারীরা মোবাইল ও টাকা-পয়সাও কেড়ে নেয়।

ছাত্রলীগ-আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া:এদিকে উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনকারীদের হামলার খবর পেয়ে বিভিন্ন হল থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে রাত সোয়া দুইটার দিকে লাঠি ও রড নিয়ে ভিসি চত্বরে অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের ধাওয়া দেয়।

 সে সময় তাদের পিটুনির শিকার হয় আন্দোলনকারীরা। ধাওয়া আর পিটুনিতে আন্দোলনরত ছাত্ররা বাংলা একাডেমির দিকে আর ছাত্রীরা টিএসসির ভেতরে ঢুকে যায়। কর্মচারীরা গেটে তালা লাগিয়ে দিলে ছাত্রীরা সেখানে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাত ৩টার দিকে প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী বিভিন্ন ছাত্রী হলের প্রভোস্ট ও সহকারী প্রক্টরদের নিয়ে টিএসসিতে যান। তিনি টিএসসির ভেতরে ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে তাদের হলে ফেরত পাঠানোর কথা বলেন। কিন্তু ছাত্রীরা আন্দোলন ছেড়ে হলে ফিরতে অস্বীকার করে। সকাল ৬টার দিকে আন্দোলনকারী ছাত্রীরা হলে চলে যায়।

এদিকে, বাংলা একোডেমির সামনে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারী ছাত্ররা পুলিশের ধাওয়ায় কার্জন হলে চলে যায়। ভোর সাড়ে ৫টার দিকে পুলিশের একটি দল ঢাকা মেডিকেলের দিকে গিয়ে জরুরি বিভাগের ফটকের কাছে সব দোকান বন্ধ করে দিয়ে উত্সুক জনতাকে সরিয়ে দেয়। পরে তারা চানখাঁর পুলের মোড়ের কাছে অবস্থান নেয়। পুলিশের আরেকটি দল তখনও দোয়েল চত্বরে অবস্থান নিয়ে ছিল। ভোর ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ ীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবিদ আল হাসান এবং সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে তিন শতাধিক ছাত্রলীগ কর্মী রড ও লাঠি নিয়ে মধুর ক্যান্টিন থেকে শহীদুল্লাহ হলের দিকে যায়। সেখানে থাকা আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগ কর্মীরা পেটাতে শুরু করে। পুলিশও তখন হলের দিকে টিয়ার শেল ছুড়তে শুরু করে। প্রথমে আন্দোলনকারীরা পিছু হটে হলের ভেতরে চলে যায়। তারা আবার সংগঠিত হয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের ধাওয়া দিলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ কর্মীরা দোয়েল চত্বরের দিকে পিছিয়ে যায়। পুলিশ ও ছাত্রলীগ দোয়েল চত্বরের দিকে চলে গেলে আন্দোলনকারীরা শহীদুল্লাহ হলের সামনে অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে ৭টার পর তিন নেতার মাজারের দিকে থাকা পুলিশ আবার ধাওয়া দিলে তারা শহীদুল্লাহ হলের ভেতরে ঢুকে যায়।

সর্বশেষ খবর