মঙ্গলবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
টাকার লোভ দেখিয়ে ভুয়া দলিল রেজিস্ট্রি

আনসার বাহিনীর নজিরবিহীন ঘটনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

জমির মালিক নয়, এমন একজন সংখ্যালঘু পরিবারকে কোটি কোটি টাকার লোভ দেখিয়ে একটি সাধারণ আমমোক্তারনামা (জেনারেল পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয় আনসার বাহিনী। দলিলগ্রহীতা হিসেবে আনসারের ডিজির নাম ব্যবহার করে সেই দলিল রেজিস্ট্রি হয় ২৮ মার্চ নগরীর বাড্ডা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। ওই দলিলে জমির রক্ষণাবেক্ষণ ও মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনার পাওয়ার দেওয়া হয়েছে। অথচ তারা দলিলের শর্ত ভেঙে ভাটারা এলাকায় সেই জমি জোরপূর্বক দখল করতে যায়। তাদের হামলায় এলাকার নিরপরাধ পাঁচজন মানুষ গুরুতর আহত হন। এ অন্যায় প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন আনসারের কতিপয় সদস্য। ওই ঘটনায় রীতিমতো হতবাক খোদ দলিলদাতা রামকৃষ্ণ কৈবর্ত দাস। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো আনসার বাহিনীকে জমি দখলের পাওয়ার দিইনি। তারা টাকার লোভ দেখিয়ে আমার কাছ থেকে একটি সাধারণ পাওয়ার দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয়, যার মাধ্যমে জমির মালিকানা-স্বত্ব প্রমাণিত হয় না। এ ছাড়া ওই দলিল রেজিস্ট্রির পর আমি পুরনো একটি দলিল থেকে জানতে পারি, আমার বাবা ওই জমি অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। বাবার বিক্রি করে দেওয়া জমির আরেকটি পাওয়ার দলিল করে দিয়ে আমি ভুল করেছি।’

তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালাই। তাই আনসার সদস্যদের কোটি কোটি টাকার লোভ সামলাতে পারিনি। ফলে আগে বিক্রি করে দেওয়া জমি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আনসারকে একটি পাওয়ার দলিল দিই। এখন দেখছি সেই দলিল নিয়ে তারা অন্যের জমি দখল করার চেষ্টা করছে। এলাকাবাসীর ওপর গুলিবর্ষণ করছে। এ কারণে আমি সে দলিল প্রত্যাহার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।’

রামকৃষ্ণের ছেলে বিপ্লব চন্দ্র দাস বলেন, ‘বাবা অনেক বয়স্ক মানুষ। জমিজমা নিয়ে আমাদের কিছু ঝামেলা ছিল। কিন্তু আমার দাদার বিক্রি করে দেওয়া জমি আনসার বাহিনীকে রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ ওই জমির মালিক তো আমরা নই। তাহলে বাবার দেওয়া দলিলটি ভুয়া। এ দলিল সৃষ্টির জন্য আমরা এলাকাবাসীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। সেই ভুয়া দাতার দলিল নিয়ে আনসারের মতো একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার সদস্যরা কীভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায় তা-ই বুঝে উঠতে পারছি না।’

জাল দাতার রেজিস্ট্রিকৃত দলিলে এক নম্বর সাক্ষী হয়েছেন ভরতচন্দ্র দাস। তিনি রামকৃষ্ণ দাসের ভাই। তিনি বলেন, ‘জমির মালিক সম্পর্কে আমি কোনো তথ্যই জানি না। আমার ভাই যে ওই জমির মালিক তাও আমার জানা নেই। আমরা জানি এসব জমি অনেক আগেই বাবা-চাচারা বিক্রি করে দিয়েছেন। আমি শুধু আনসার সদস্যদের কথামতো দলিলে সাক্ষী হয়েছি। গরিব মানুষ হিসেবে কিছু টাকা পাওয়ার লোভে সেটা করেছি। এখন বুঝতে পারছি এ সাক্ষী হওয়া ছিল আমার জন্য বড় ভুল।’ কৈবর্ত দাস পরিবারের একাধিক সদস্য জানান, মূলত আনসার সদস্যদের প্ররোচনায়ই তারা ভুয়া দাতা সেজে একটি দলিল রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেছেন আনসার কমান্ডার ফরিদ, রায়হান, কামরুজ্জামান ও ফরিদ। তারাই আমাদের ফুসলিয়ে এ অন্যায় কাজ করতে বাধ্য করেছেন। তাদের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে ছিলেন গুলশান সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক (সনদ নম্বর-৮০) নজরুল ইসলাম ও রহমান ভেন্ডার। তারা আরও জানান, কোটি কোটি টাকার লোভ দেখিয়ে ভুয়া দাতার কাছ থেকে দলিল রেজিস্ট্রি করে নিলেও তাদের কোনো টাকা-পয়সা দেননি আনসার সদস্যরা। যেদিন দলিল রেজিস্ট্রি করা হয় সেদিন দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়ার জন্য রামকৃষ্ণ দাসের হাতে এক হাজার টাকার একটি নোট ধরিয়ে দেওয়া হয়। দলিল রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর তাদের না বলেই আনসার সদস্যরা সেখান থেকে চলে যান। এ ঘটনায় তাদের মনে সন্দেহ ঢোকে, হয়তো তারা জমিজমা নিয়ে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটানোর জন্য এটা করেছেন। আনসারের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কতিপয় আনসার সদস্য নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য জমি দখলের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটিয়েছে। জমি দখল কিংবা সন্ত্রাসীদের মতো কার্যকলাপ চালানো তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। ভাটারার ঘটনার পর সাধারণ মানুষের কাছে পুরো আনসার বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা এ বাহিনী দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে।’ স্থানীয় সূত্র জানায়, একসময় বেশ কয়েকটি কৈবর্ত দাস পরিবার ভাটারা এলাকায় বসবাস করত। তারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করত। ধীরে ধীরে এলাকায় নগরায়ণ শুরু হলে জমিজমার দাম অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে তারা সেসব জমি বিক্রি করে অন্যত্র বসবাস শুরু করে। আর এ কারণে পাকিস্তান আমলের আরএস এবং বাংলাদেশ আমলের সিটি জরিপে সেসব জমি রেকর্ড হয় পরবর্তী মালিকদের নামে। ভাটারার স্থায়ী বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সিএস ও এসএ রেকর্ডীয় মালিক থাকা অবস্থায় হিন্দু সম্প্রদায় এসব জমি বিক্রি শুরু করে। এখানে তাদের প্রায় ২৫-৩০ বিঘা জমি ছিল। বিক্রি করতে করতে অনেকে ওয়ারিশান সম্পত্তি থেকে বেশি সম্পত্তি বিক্রি করে ফেলেন। এ কারণে তা নিয়ে অনেক মামলা-মোকদ্দমার জন্ম হয়। রামকৃষ্ণ দাসের বাবা যোগেশ চন্দ্র দাস তার পাওনার চেয়ে বেশি জমি বিক্রি করে দেন। এ কারণে পরবর্তী সময় তাকে একটি ক্ষতি-নিষ্পত্তি দলিল করে সে সমস্যার সমাধান করে দিতে হয়। এরপর তার ছেলে রামকৃষ্ণ কীভাবে আরও জমি আনসারের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করে দেন সেটাই আমরা ভেবে পাই না।’ স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, দীর্ঘদিন ধরে জমি ভোগদখলে থাকার পর প্রকৃত মালিকদের নামে আরএস ও সিএস রেকর্ড হয়েছে। এতদিন সেসব জমির মালিকানা নিয়ে কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি। হঠাৎ করে রামকৃষ্ণ দাসের একটি সাধারণ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল নিয়ে আনসার সদস্যরা এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শুরু করেন। অথচ আনসার সদস্যদের উচিত ছিল রেকর্ড সংশোধনের পর দলিল রেজিস্ট্রি করা। অন্যের রেকর্ডকৃত ভোগদখলে থাকা জমি একটি সরকারি বাহিনীর দখল করতে আসা শুধু বেআইনিই নয়, লজ্জাজনক ঘটনা। সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বর্তমানে আনসারের কোনো সদস্য নেই। শুধু তাদের দুটি তাঁবু পড়ে আছে। কৈবর্ত দাস পরিবারের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে সেই জমির মালিক আজিজুর রহমান বলেন, ‘১৬০১ ও ১৬০২ দাগের জমিগুলো আমাদের দখলে রয়েছে। হঠাৎ করে সেগুলো আনসার বাহিনী দখল নিতে আসে। এটা যেন মগের মুল্লুক। এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে তারা সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়।’

সর্বশেষ খবর