শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ঢামেকে ভয়ঙ্কর রেড শার্ট

গতকাল দুপুর ১২টা ২০ মিনিট। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থামল একটি সিএনজি। ভিতরে মায়ের কোলে ঘুমন্ত অবস্থায় শাহিদা খাতুন (১৪)। সিএনজি থেকে নামতেই গেটে ট্রলি নিয়ে হাজির হন রেড শার্ট পরিহিত এক যুবক। ওই যুবক শাহিদাকে টলিতে তুলে নিয়ে যান জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকের  কক্ষের সামনে। এরপর টিকিট কাটাসহ প্রাথমিক প্রক্রিয়া শেষ করতেই চলে যায় প্রায় ২০ মিনিট। এর মধ্যে জরুরি বিভাগে আসে আরও দুজন রোগী। তারাও ট্রলিতে শোয়া অবস্থায় কর্তব্যরত চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন। তাদের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে প্রায় একই অবস্থা হয়। রোগী নিয়ে যেতে ট্রলি নিয়ে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন রেড শার্ট পরিহিতরা। ১২টা ৪০ মিনিটের দিকে জরুরি বিভাগ থেকে একজন রোগীকে ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হয় ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনে। সেখানে পৌঁছে দিয়েই ট্রলি বহনকারী যুবকটি চেয়ে বসেন বকশিশ। তাকে রোগীর স্বজনরা প্রথমে একশ টাকা দেন। এতে তার মন ভরেনি। পরে তাকে আরও একশ টাকা দিতে বাধ্য হলেন। শুধু এই দুই রোগীই নয়, এমন শত শত রোগী জিম্মি রেড শার্ট পরিহিতদের কাছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, হাসপাতালে তিন শিফটে এ ধরনের রেড শার্ট পরা প্রায় ৪০ জন যুবক ডিউটি করেন। হাসপাতাল থেকে তাদের কোনো বেতন-ভাতার ব্যবস্থা নেই। তাদের সেবায় মুগ্ধ হয়ে রোগীর স্বজনরা ‘যা দেবেন, সেটাই তার আয়’। এ নিয়ে তারা কোনো জোরাজোরি করতে পারবেন না। শুধু ট্রলি বহনই নয়, তারা রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সও নির্ধারণ করে দেন। ট্রলি বহনের সুবিধায় তারা রোগীর স্বজনদের কাছে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থার কথা বলে জিম্মি করে বেশি ভাড়া আদায় করে থাকেন। আর এই হাসপাতালেই রয়েছে অ্যাম্বুলেন্সের বিশাল সিন্ডিকেট। এই রেড শার্টধারীরা বাইরের কোনো অ্যাম্বুলেন্সকে ভিড়তে দেন না। তাদের নির্ধারিত অ্যাম্বুলেন্সই ঢামেকে আসা রোগীদের বহন করবে— এমনও অলিখিত আইন জারি করে রেখেছেন তারা। এই রেড শার্টধারীদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দায়িত্বপালনরত আনসার সদস্যদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. বিদ্যুৎ কুমার পালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লাঞ্চে অবস্থান করছেন এবং ৩০ মিনিট পরে ফোন দেওয়ার কথা বলেন। এরপর রাত সাড়ে ৮টার দিকে তার মোবাইলফোনে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। গতকাল সরেজমিনে হাসপাতালে ঘুরে দেখা গেছে, চিকিৎসাসেবা নিয়ে রোগীদের যত না অভিযোগ, তার চেয়ে বেশি অভিযোগ হাসপাতালে দালাল চক্রের বিরুদ্ধে। হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে প্রথমে ট্রলি বহনকারীদের বখশিশ দিয়ে ভোগান্তি শুরু হয়। এরপর নানা পরীক্ষার মেশিন না থাকার অভিযোগে রোগীদের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিটিস্ক্যান ও এমআরই মেশিন ঢাকা মেডিকেলে নেই। এসব পরীক্ষার জন্য ওই ট্রলি বহনকারীরাই দেখিয়ে দেন তাদের সিন্ডিকেটে জোগসাজশ থাকা হাসপাতালগুলোতে। অথচ এসব পরীক্ষায় ঢাকা মেডিকেলে ২-৫ হাজার টাকা লাগত। যা বাইরের হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে খরচ দাঁড়ায় ১৫ হাজার।  জানা গেছে, প্রতিটি ট্রলির বিপরীতে দুজন রেড শার্ট পরিহিত দায়িত্ব পালন করেন। সবগুলোকে দেখভালের জন্য একজন সর্দার রয়েছেন। সারাদিন তাদের যে আয় হয় তার তিন ভাগের একভাগ দিতে হয় সর্দারকে। ওই টাকার ভাগ হাসপাতালের প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যায় বলেও জানা গেছে।

হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক জানান, মাঝে মধ্যেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই হাসপাতালে পরিদর্শনে এসে কোনো সমস্যা আছে কিনা তা জানতে চান। সমস্যার কথাগুলো না জানিয়ে ‘সব ঠিক আছে’—এমন বার্তা দেওয়া হয়। ফলে সমস্যাগুলো সমাধান হচ্ছে না।

সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স না থাকা এবং এর সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থাপনার ঘাটতির সুযোগ নিয়ে রাজধানীর দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালের কর্মচারীরা বেআইনি ও অবৈধ অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসা জমিয়ে তুলেছেন। এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। উল্টো এ বিষয়ে তারা নির্বিকার। এই পরিস্থিতিতে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। হাসপাতালে চাকরিরত এসব অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ীর কাছে তারা অনেকটাই জিম্মি। দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ১৪ জন কর্মচারী অবৈধভাবে ২০টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা করছেন। এ ছাড়া মিটফোর্ড ও পঙ্গু হাসপাতালে বর্তমানে কর্মরত ও সাবেক কর্মচারীর স্বজনদের এমন ১০টি অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা রয়েছে। অভিযোগ আছে, এই অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার পেছনে মূলত ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত কর্মচারী নেতাদের ভূমিকা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ভুক্তভোগী রোগীর স্বজনেরা বলছেন, রাজধানীর ভিতরে সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে ৩০০ টাকায় রোগী আনা-নেওয়া করা যায়। কিন্তু কর্মচারীরা দেড়-দুই হাজার টাকায় উঠতে রোগীদের বাধ্য করেন। দালালের মাধ্যমে লাশ বা রোগী পরিবহনে কম ভাড়ার কথা বলে পরে বিভিন্ন খরচের নামে দ্বিগুণ-তিনগুণ অর্থ আদায় করা হয়। রাতে কিংবা দূরপাল্লার চলাচলের জন্য রোগীর স্বজনদের এসব অ্যাম্বুলেন্সের ওপর নির্ভর করতে হয়। কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের কথা না শুনলে তারা অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনাকারী কর্মচারীদের অন্যত্র বদলিও করে দেন। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স আছে সাতটি। এর মধ্যে দুটি বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট ব্যবহার করে। তিনটিতে হাসপাতালের রোগী আনা-নেওয়া করা হয়। দুটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। হাসপাতালে ১১ জন কর্মচারী অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায় জড়িত। তাদের ১৬টি অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসার নেপথ্যে রয়েছেন হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর