শুক্রবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বিশ্বমানের সেবার নিশ্চয়তা বারডেমে

সকাল ৯টা। বারডেম হাসপাতালের বহির্বিভাগে পা ফেলার জায়গা নেই। রক্ত পরীক্ষা করাতে দিয়ে অপেক্ষায় আছেন রোগীরা। প্যাথলজিতে প্রয়োজনীয় টেস্ট করাতে দিয়ে অপেক্ষা করছেন রোগী ও তার স্বজনরা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন অ্যান্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডার সংক্ষেপে ‘বারডেম’ চালিত এই হাসপাতালে এসেছে কুড়িগ্রামের মিজান আলী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনী রোগে ভুগছেন। এতদূর থেকে এই হাসপাতালে এসেছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগে ঢাকার দুই হাসপাতালে গিয়েছি কিন্তু ৮ হাজার টাকার টেস্ট করিয়ে বলছে অপারেশন করতে হবে। এজন্য ৩ লাখ টাকা চাইছে। এতো টাকা দিয়ে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য আমার নাই। এক আত্মীয় জানালো এই হাসপাতালের সেবা যেমন ভালো আবার গরীবদের জন্য আছে সহযোগিতার ব্যবস্থা। তাই ঢাকায় আমার শেষ ভরসা এই হাসপাতাল। শুধু অস্বচ্ছল নয় ধনী-গরিব সবাইকে ৩৮ বছর ধরে বিশ্বমানের সেবা দিয়ে আসছে এই হাসপাতাল। ১৯৫৬ সালে ডায়াবেটিক সমিতি থেকে ১৯৮০ সালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু করে এই হাসপাতাল। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ শয্যার বারডেম হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ডায়াবেটিস যে একদিন বড় মাপের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হয়ে দেখা দেবে, এটা তিনি গত শতকের পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তার নেতৃত্বে ১৯৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (তখন নাম ছিল ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তান) গঠিত হয়। অধ্যাপক ইব্রাহিম সমিতির কাছে সেগুনবাগিচায় তাঁর বাড়ির নিচতলার একটি কক্ষ ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। ওই বাড়িতেই ডায়াবেটিস সেবার জন্য বহির্বিভাগ চালু করা হয়। সেখানেই শুরু হয় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা। হাসপাতালের জন্য সমিতিকে সেগুন বাগিচায় কিছু জমি দিয়েছিল পাকিস্তান সরকার। শাহবাগে বর্তমান জায়গায় হাসপাতাল আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৮০ সালে। ২০১৩ সালে সেগুনবাগিচায় বারডেম-২ হাসপাতাল চালু করা হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশনের স্বতন্ত্র নয়টি প্রতিষ্ঠান। সময়ের বিবর্তনে আজকের বহুমুখী চিকিৎসাসেবা, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়েছে এই হাসপাতাল। এখানে ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিজম বিষয়ে এমফিল, এমডি এবং পিএইচডিসহ ডিপ্লোমা ও ডিগ্রি কোর্স পরিচালিত হয়। এ ছাড়া জেনারেল সার্জারি, চক্ষু, মেডিসিন, গাইনি, অ্যানেসথেসিয়া, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন প্রভৃতি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে। যে কোনো রোগীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য এখানে মোট বিভাগ রয়েছে ৬০টি। ডায়াবেটিসের বিশেষ সেবাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি থাকলেও এখানে ওপেন হার্ট সার্জারি, বাইপাস সার্জারি, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টটেশন, ভাল্ব রিপ্লেসমেন্ট, ইউরটরি লিটোটমি, হেপাটোলপি, জেনারেল সার্জারি, ইউরোটোলজি, ল্যাপারোকোলি। তিনতলায় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি এবং নিচতলায় রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগ স্থাপন করা হয়েছে। বারডেমের পরিচালক (হাসপাতাল ও প্রশাসন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শহিদুল হক মল্লিক জানান, হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৭১৬টি। এর মধ্যে ১১০টি শয্যা দরিদ্র রোগীদের জন্য। দরিদ্রদের বিনা মূল্যের শয্যাগুলো ১০০ শতাংশ পূর্ণ থাকে। পূর্ণ থাকে অন্য শয্যাগুলো ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। প্রতিদিন এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে গড়ে যে ৩ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে আসে, তার একটি বড় অংশ আসে নিয়মিত চিকিৎসায়। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের নিবন্ধন করতে হয়। তিনি বলেন, নতুন করে শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর আপাতত সিদ্ধান্ত নেই। আমরা রোগীদের সেবা, খাবার, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাড়ানোতে জোর দিচ্ছি। প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সেবা দিয়ে রোগী ও তার স্বজনদের আস্থা অর্জনই আমাদের সার্থকতা। উন্নত সেবার জন্য শুধু দেশের ভিতরে নয়, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে বারডেম। ১৯৮২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বারডেমকে তাদের সহযোগী কেন্দ্র হিসেবে মর্যাদা দেয়। এশীয় অঞ্চলে বারডেমই প্রথম হাসপাতাল যেটি ‘ডব্লিউএইচও কোলাবরেটিং সেন্টার ফর প্রিভেনশন, ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কন্ট্রোল অব ডায়াবেটিস’-এর স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৩ সালে বারডেম স্বাধীনতা পদক পায়। ২০০৪ সালে ইবনে সিনা পুরস্কার পায় হাসপাতালটি। এ ছাড়া ২০১৪ সালে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এমসিসিআই) বিশেষ পদক দেয় এই হাসপাতালকে।

সর্বশেষ খবর