বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

চলেই গেলেন রাজীব

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলেই গেলেন রাজীব

২১ বছরের টগবগে তরুণ রাজীব হোসেন। বয়সটি স্বপ্নের, স্বপ্ন দেখার। রাজীবও স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে ছুটে চলেছেন অবিরত। মায়াবী চেহারায় তার ছিল না কোনো ক্লান্তির ছাপ। ৮ বছর বয়সে মা আর ১৪ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর কষ্ট বুকে  চাপা দিয়ে জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল রাজীব। দুঃখ-দুর্দশার মাঝেও সেই যুদ্ধে হারেনি কখনো। কিন্তু এবার তাকে হারতে হলো। সবাই তাকে হারালো। সবাইকে কাঁদিয়ে চলেই গেল রাজীব। তাকে হারিয়ে শুধু স্বজনরাই নয়, কেঁদেছেন সাধারণ মানুষ। চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকরা কান্না করেছেন বাচ্চাদের মতো। সোমবার মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেন। আর তার মৃত্যুতে শেষ হয় তার সেই স্বপ্ন। গত ৩ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজার সংলগ্ন সার্ক ফোয়ারার পাশে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহন নামে দুই বাসের হিংস  প্রতিযোগিতায় হাত হারায় রাজীব। যে প্রতিযোগিতা মুহূর্তেই কেড়ে নেয় রাজীবের বেঁচে থাকার অবলম্বন, স্বপ্ন গড়ার হাতিয়ার ডান হাতটি। এরপর তার বিচ্ছিন্ন হাতসহ তাকে নেওয়া হয় শমরিতা জেনারেল হাসপাতাল এবং পরে ঢামেকে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু কোথাও বিচ্ছিন্ন হাত জোড়া লাগানো সম্ভব হয়নি। গঠন করা হয় চার সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। ঢামেকের আইসিইউতে ক্রমেই সে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগছিল। হাত হারালেও ওই সময় মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ায় মস্তিষ্কের সামনের অংশে রক্ত ও পানি জমে যায়। টানা পাঁচ দিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে গত ৯ এপ্রিল চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন পরের দিন আইসিইউ থেকে ওয়ার্ডে স্থানান্তর করবেন। কিন্তু তার আগেই সবাইকে শঙ্কায় রেখে রাজীবের অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ওয়ার্ডের বদলে তাকে দেওয়া হয় লাইফ সাপোর্ট। এরপর এক সপ্তাহ লড়ে হেরে যান মৃত্যুর কাছে।  রাজীব ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী। এ জন্য ছোট বেলা থেকেই সহপাঠীরা বলত তাকে ডাক্তার হতে। তারও স্বপ্ন ছিল এটি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে মা-বাবাকে হারিয়ে অসহায় রাজীব সেই স্বপ্নকে আর ধরে রাখতে পারেননি। একদিকে অর্থাভাব, অন্যদিকে অসহায় ছোট দুটি ভাই। সব কিছু মিলিয়ে রাজীব নিজের স্বপ্ন ত্যাগ করে ছোট ভাইদের জন্য স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।

তিনি পটুয়াখালীর বাউফলের ফজলুল হক কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন। এখান থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করতে আরও তিন বছর লাগবে। ছোট ভাইদের কথা চিন্তা করে দ্রুত একটি ডিগ্রি নিয়ে সরকারি চাকরির আশায় ভর্তি হয়েছিলেন রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজে। সেখানেও সে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলেন। আর এক বছর পর পরীক্ষা শেষে একটা চাকরি নেওয়ার আশায় ছিলেন। তার আগেই সব আশা নিরাশায় পরিণত হলো।

রাজীবের খালা জাহানারা বেগম বলেন, কখনো ভাবতে পারিনি রাজীব মারা যাবে। সর্বশেষ আইসিইউতে যে দিন নেওয়া হয় সেদিনও রাজীব স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলেছে। তাকে নিজ হাতে জুস খাইয়েছি। লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগ পর্যন্ত রাজীব বেঁচে যাবেন বলে ধরে নিয়েছিলাম। বাবা-মা হারানো রাজীব ছোট দুই ভাই মেহেদি ও হাসানকে নিয়ে সুখের স্বপ্ন দেখত। তিতুমীর কলেজে নিজের পড়াশোনা, টিউশনি ও কম্পিউটারে গ্রাফিক্স ও টাইপিংসহ বিভিন্ন কাজ করে সংসার চালাত। তার কষ্টের টাকায় ছোট দুই ভাই পড়াশোনা করত। 

শুরুতে রাজীবের জীবন নিয়ে ততটা শঙ্কা না থাকলেও লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার পর তার নিয়তি যেন অনেকটা নির্ধারিতই হয়ে গিয়েছিল। এরপরও সোমবার রাতে রাজীবের মৃত্যুতে হাহাকার করেন অনেকে। বুকের ভিতর এমন হাহাকার অনুভব করেছেন তার চিকিৎসকরাও।

ঢামেক হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান ও রাজীবের চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. এমএস জামান শাহীন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, এমন মৃত্যু ঠেকানোর দায়িত্ব আমার, আপনার, সমাজের, রাষ্ট্রের। সাময়িক উন্নতির পর রাতে তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রাজীবের মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যায়। এরপর রাত ১২টা ৪০ মিনিটে রাজীবের মৃত্যু হয়। রাজীবের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, যে ত্রুটির কারণে এমন মৃত্যু। সেই ত্রুটিগুলো সারানো দরকার। আগেও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হয়ে আসতেন। এখন এই সংখ্যা অনেক বেশি। 

বাসচালকের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন : রাজীবের মৃত্যুর জন্য দায়ী বাসচালকের শাস্তির দাবিতে গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছে যাত্রী অধিকার আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। 

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, রাজধানীর গণপরিবহনগুলোর চালকদের বেপরোয়া আচরণের কাছে সাধারণ মানুষের প্রাণ যেন কিছুই নয়। তারা রাস্তায় নেমে জীবন নিয়ে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। যার প্রমাণ রাজীবের মৃত্যু, আয়েশার মেরুদণ্ড ভাঙা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত রুনা আক্তারের পা থেঁতলে যাওয়া।

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির আহ্বায়ক কেফায়েত শাকিল, যুগ্ম আহ্বায়ক মুজাহিদুল ইসলাম, মাহমুদুল হাসান শাকুরী, মাঈন উদ্দিন আরিফ, মনিরুল ইসলাম, সজীব, মাহফুজ বিন শাকুরী, এনামুল ও হাসান আল বান্না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর