বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
সুবিধা বন্ধ হলে টাকা বিদেশ চলে যাবে
ফ্ল্যাট প্লট বাণিজ্যিক ভবনে বিনিয়োগে দায়মুক্তি চায় রিহ্যাব

অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ থাকছে বাজেটে

—মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, চেয়ারম্যান, এনবিআর

নিজস্ব প্রতিবেদক

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেছেন, অপ্রদর্শিত আয় জরিমানা দিয়ে বৈধ করার চলমান সুযোগ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটেও অব্যাহত থাকবে। বিষয়টি স্পষ্ট করে তিনি আরও বলেন, প্রতি বছরই অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ হয়ে আসছে। এটা রিটার্নে দেখানোর সময় জরিমানাসহই দেখানো হয়। এই সুবিধা যদি আমরা বন্ধ করে দিই, তাহলে টাকাগুলো বাইরে চলে যাবে। দেশের উৎপাদনশীল খাতে এই টাকা ব্যবহার হবে না। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করবেন না যে, আমরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিচ্ছি। আমি তো কর নিয়ে দিচ্ছি, জরিমানাসহ নিচ্ছি। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আয়োজিত প্রাক-বাজেট মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। আগামী অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে অনুষ্ঠিত এই সভায় অংশ নেয় রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)। সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া মিলন রিহ্যাবের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার অ্যাসোসিয়েশন, রি-রোলিং মিলস অ্যাসোসিয়েশন, ইট-পাথর ব্যবসায়ী সমিতিসহ বিভিন্ন লিংকেজ শিল্পের প্রতিনিধি নিজ নিজ সংগঠনের প্রস্তাব তুলে ধরেন। ওই মতবিনিময় সভায় ফ্ল্যাটের নিবন্ধন ফি কমানোর দাবি প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, রিহ্যাবের বিষয়গুলো আমাদের দেখতে হবে। নিবন্ধন ফি কমানোর বিষয়ে চিন্তা করা হবে। আবাসনশিল্পের সমস্যা সমাধানে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করতে কর্মকর্তাদের তত্ক্ষণাৎ নির্দেশনা দিয়ে বলেন, এই খাতে সেকেন্ডারি বাজারব্যবস্থা প্রচলনের বিষয়ে দ্রুত পরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেবে এনবিআর। রিহ্যাবের প্রথম সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া মিলন বলেন, বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হোক। একই সঙ্গে স্বল্প ও মধ্যবিত্তদের আবাসন সমস্যা সমাধানে ফ্ল্যাটের নিবন্ধন খরচ ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক। অর্থাৎ রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি, গেইন ট্যাক্স কমিয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ করা, সাপ্লায়ার ভ্যাট ও উৎসে কর সংগ্রহের দায়িত্ব থেকে পাঁচ বছরের জন্য ডেভেলপারদের অব্যাহতি দেওয়া হোক। আবাসন খাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সিঙ্গেল ডিজিট সুদে দীর্ঘমেয়াদি পুনরর্থায়ন বা রি-ফাইন্যান্সিং সুবিধা চালু করুক। সভায় মোট ১২টি প্রস্তাব দেয় রিহ্যাব। এর মধ্যে বৈধভাবে উপার্জিত অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে আয়কর অধ্যাদেশ-১৯৮৪-এর ধারা ১৯বির যুগোপযোগী সংশোধন চেয়েছে রিহ্যাব। এ-সংক্রান্ত সুপারিশে রিহ্যাব বলেছে, আবাসন খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য গৃহায়ণ খাতে অপ্রদর্শিত অর্থ ফ্ল্যাট, প্লট, বাণিজ্যিক ভবন ও বিপণিবিতানে বিনিয়োগের জন্য আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১৯বিবিবিবিবিতে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) রেখে সংশোধন করা প্রয়োজন। এর ফলে দেশের জাতীয় সম্পদ ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে। দায়মুক্তির পক্ষে রিহ্যাব আরও বলেছে, আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ১৯বি অবিলম্বে পুনঃপ্রবর্তন করা না হলে, বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হওয়া উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে। এ ছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ গ্রহণের সুযোগ থাকায় দেশের প্রচুর অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এসব দেশে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার অর্থের উৎস বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না। অপ্রদর্শিত অর্থ দেশে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হলে, ভবিষ্যতে ওইসব বিনিয়োগকারী করজালের আওতায় চলে আসবেন। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে। কিন্তু ১৯বিবিবিবিবিতে দায়মুক্তি না থাকার কারণে দেশের রাজস্ব আয় বাড়ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে দেশে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়সংক্রান্ত অজস্র চিঠি বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তিকে পাঠানোর কারণে আবাসন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশ ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে; যা যৌক্তিক পর্যায়ে এনে বন্ধ করা অত্যাবশ্যক।

রিহ্যাবের অন্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে : আবাসন খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিঙ্গেল ডিজিট সুদে দীর্ঘমেয়াদি রি-ফাইন্যান্সিং চালুকরণ এবং ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন। ফ্ল্যাট ও প্লট রেজিস্ট্রেশন-সংশ্লিষ্ট কর ও ফি সর্বমোট ৭ শতাংশ নির্ধারণ। আবাসনশিল্প রক্ষায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিদ্যমান মূল্য সংযোজন করের (মূসক বা ভ্যাট) হার কমিয়ে নতুনভাবে ভ্যাট আরোপ না করা। গৃহায়ণশিল্পের উদ্যোক্তাদের আয়কর হার কমানো। আয়কর অধ্যাদেশের ধারা ৫৩পি অনুসারে গেইন ট্যাক্স ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করে নিয়মিত এসেসমেন্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করা। বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনকে তহবিল প্রদানের মাধ্যমে আবাসন খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়ানো। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) আওতাভুক্ত ও বহির্ভূত এলাকায় সব জমির ক্ষেত্রে আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩এইচ ধারায় আরোপিত কর প্রত্যাহার। ক্রেতা, জমির মালিক ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য অসমাপ্ত প্রকল্পগুলোয় বিশেষ ঋণের প্রচলন। সরবরাহকারী বা সাপ্লায়ার ভ্যাট ও উৎসে কর সংগ্রহের দায়িত্ব থেকে পাঁচ বছরের জন্য ডেভেলপারদের অব্যাহতি প্রদান। বিকেন্দ্রীকরণ নগরায়ণ ও পারিপার্শ্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শহর এলাকায় পাঁচ এবং শহরের বাইরের এলাকায় ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডের সুযোগ প্রদান। নামমাত্র রেজিস্ট্রেশন ব্যয় নির্ধারণ করে আবাসন খাতে ‘সেকেন্ডারি বাজার’ব্যবস্থার প্রচলন করা হোক। ওই সভায় অংশ নেওয়া বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা কামাল ৫ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বলেন, চাহিদার ৩ কোটি টন সিমেন্ট দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি ও ব্যাংক সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় খাতটি বর্তমানে হুমকির মুখে। সংগঠনটির পক্ষে সিমেন্ট উৎপাদন খাতে অগ্রিম আয়কর বাতিল, ক্লিংকার আমদানির ওপর শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, অন্যসব মৌলিক কাঁচামালের শুল্কহার ৫ শতাংশ করা, ইনভয়েস মূল্যে শুল্কায়নের ব্যবস্থা নেওয়া এবং সরকারে মেগা প্রজেক্ট ব্যবহার হওয়া, বাল্ক ক্যারিয়ারের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন মোস্তফা কামাল। বাংলাদেশ রি-রোলিং অ্যান্ড স্টিল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, রডসহ এমএস পণ্য প্রস্তুতকরণ ও সরবরাহ পর্যায়ে ট্যারিফ কমাতে হবে। গর্দা বা মেলটেবল স্ক্র্যাপ থেকে প্রস্তুত হওয়া ইনগট বা বিলেট এবং ইনগট বা বিলেট থেকে প্রস্তুত হওয়া পণ্যের ট্যারিফ মূল্য ৬ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হোক। এ ছাড়া ফেরাস ওয়েস্ট অ্যান্ড স্ক্যাপ আমদানিতে সিডি ১ হাজার ৫০০ টাকা প্রত্যাহার করা ও অগ্রিম আয়কর বা এআইটি ৮০০ থেকে কমিয়ে ৪০০ টাকায় নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি। বাংলাদেশ পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী আবদুল আহাদ বলেন, দেশে পাথর থাকা সত্ত্বেও পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। আমরা পাথর উত্তোলনের সুযোগ চাই।

সর্বশেষ খবর