বুধবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

হঠাৎ বেড়েছে বন্দুকযুদ্ধ

সাখাওয়াত কাওসার

গত ৬ এপ্রিল। রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ হয় সন্ত্রাসীদের। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রাকিব হাওলাদার (২২)। পুলিশ জানায়, ডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা। অভিযান চালানোর সময় প্রথমে দুর্বৃত্তরা গুলি চালায়। পুলিশও পাল্টা জবাব দেয়। এ সময় রাকিব মারা যায়। ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেছেন, গত বছর ৮ অক্টোবর ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খন্দকার আবু তালহা হত্যা মামলার আসামি রাকিব। ওই ঘটনায় গ্রেফতার বেলাল হোসেন সবুজ ও আবদুর রহমান মিলনের  দেওয়া তথ্যেও রাকিবের নাম আসে। তাকে খোঁজা হচ্ছিল। সারা দেশে হঠাৎ করেই যেন বেড়ে গেছে বন্দুকযুদ্ধ। গতকালও ঢাকার ধামরাইয়ে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে তিনজন। র‌্যাব বলছে, এরা কেলিয়া গ্রামে ডাকাতির প্রস্ততি নিচ্ছিল। বন্দুকযুদ্ধে নিহতের তালিকায় রয়েছে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের অপরাধী। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য বলছে, তিন মাসে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ৪৬ জন। সবচেয়ে বেশি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে পুলিশের সঙ্গে। তবে বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে নিহতদের পরিবার নানা অভিযোগ করেছে। তাদের অভিযোগ, বাসা-বাড়ি থেকে তাদের স্বজনদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে পুলিশ বলছে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা। রাজধানীর ওয়ারীতে নিহত রাকিবের মা রিতা আক্তারের অভিযোগ, ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টার দিকে কাপ্তান বাজার এলাকায় তাদের বাসার সামনে থেকে সবার সামনে রাকিবকে ধরে নিয়ে যায় ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জ্যোতিষ চন্দ্র রায়। ওই রাতেই তিনি তার ছেলের সঙ্গে থানায় দেখা করেছেন। এ নিয়ে কয়েক দফা মোবাইল ফোনে কথাও হয়েছে এসআই জ্যোতিষের সঙ্গে। কী কারণে তাকে ধরা হয়েছে জিজ্ঞাসা করা হলে পুলিশ এর কোনো জবাব দেয়নি। বলেছে আগামীকাল (পরদিন) তাকে আদালতে পাঠানো হবে। অথচ শুক্রবার আমার ছেলের লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আসকের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কারা হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের। গ্রেফতারের আগেই তিন মাসে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে ১৪ ও পুলিশের সঙ্গে ১০ জন। এ ছাড়াও ডিবি পুলিশের সঙ্গে তিন, নৌপুলিশের সঙ্গে এক ও বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে একজন। গ্রেফতারের পরে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই, পুলিশের সঙ্গে ১১ ও ডিবি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে দুজন। পুলিশ হেফাজতে অসুস্থ হয়ে মারা গেছে একজন। ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গত তিন মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে ৩৭ জন। গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ৩৭ জন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১২ মার্চ কারা হেফাজতে ছাত্রদল নেতা জাকির হোসেন মিলনের মৃত্যুসহ বেশ কিছু বন্দুকযুদ্ধ অনেকের মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক সহিংসতাও তো নেই। তবে কক্সবাজারে ধর্ষক রহিম উদ্দিন ও আনু মিয়ার মতো জঘন্য অপরাধীর মৃত্যু আইনবহির্ভূত হলেও সাধারণ মানুষ ভালোভাবেই নেয়। এরপরও বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনো সময়ই প্রত্যাশিত নয়। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে সমাজে নজির স্থাপন করলে অপরাধ কমে আসবে। একই সঙ্গে দূর করতে হবে বিচারের দীর্ঘসূত্রতা।

আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদিন মালিক বলেন, এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চলতে থাকলে সরকারের সব উন্নয়ন প্রচেষ্টার ফলাফল হবে শূন্য। জনগণ উন্নয়নের কথা মনে রাখবে না। মনে রাখবে অন্যায় অবিচার আর হত্যকাণ্ডের কথা। ২৩ মার্চ রাজধানীর মিরপুরের ভাঙ্গা ব্রজ এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন হাসান মাহমুদ। পুলিশ বলেছে, এই যুবক পীরেরবাগে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত ডিবির পরিদর্শক জালাল উদ্দিন হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন আসামি। জালাল হত্যার আসামি হাসানকে গ্রেফতারের জন্য ওই এলাকায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে সন্ত্রাসীরা। পাল্টা গুলি চালায় পুলিশ। গুলিবর্ষণের এক পর্যায়ে একজনকে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। গত ২৬ মার্চ দুপুরে রহিম উদ্দিন বরই দেওয়ার নাম করে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ফুসলিয়ে নির্মাণাধীন একটি বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ সময় শিশুটি জ্ঞান হারালে রহিম উদ্দিন পালিয়ে যান। পরে ৩১ মার্চ র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় রহিম। এর আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি চকরিয়া উপজেলার বদরখালীতে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ মামলার আসামি আনু মিয়া র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনবহির্ভূত হত্যা আমরা কখনোই প্রত্যাশা করি না। প্রত্যেক ঘটনারই সুষ্ঠুভাবে বিচারিক নিষ্পত্তি দরকার। যদি প্রকৃতই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হোক।  এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতারই একটি ফিডব্যাক হচ্ছে আইনবহির্ভূত হত্যা। কারণ দীর্ঘদিন ধরে মামলা বিচারাধীন থাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার নাম করেই হয়তো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বন্দুকযুদ্ধের আশ্রয় নেন। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, অনেক অভিযানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা র‌্যাবের ওপর গুলিবর্ষণ করে। আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব সদস্যরা গুলিবর্ষণ করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হতাহতের ঘটনা ঘটে। অনেক অভিযানেই র‌্যাবের সদস্য আহত হয়েছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে এবং মারা গিয়েছেন অনেক র‌্যাব সদস্য। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক সহেলী ফেরদৌস বলেন, প্রত্যেকটি ঘটনায় অপারেশনাল ইউনিটের দেওয়া তথ্যে আমরা দেখেছি, নিহত ব্যক্তিরা বিভিন্ন মামলার আসামি। কিছু কিছু ঘটনায় তাদের কারও কারও অপরাধের বিষয়ে অন্য আসামিদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে উল্লেখ থাকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রত্যেকটি গুলির ঘটনায় আমাদের বিভাগীয় তদন্ত হয় এবং তাতে ম্যাজিস্ট্রেটের মন্তব্য থাকে।

সর্বশেষ খবর