শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফোনেও মেলে আইনি সেবা

জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ, ৯ বছরে সেবা পেয়েছে ৩ লাখের বেশি মানুষ

আরাফাত মুন্না

বুধবার দুপুর ১টা বেজে ৪৭ মিনিট। রাজধানীর বেইলি রোডে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার কল সেন্টারে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে ফোন করেছেন রোখসানা (ছদ্মনাম) নামের এক নারী। জানিয়েছেন তিনি তার স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী, দুই সন্তানও আছে। তবে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রমাণে নেই কাবিননামা। স্বামী তাকে ভরণ-পোষণ দিচ্ছেন না। কোথায় গেলে প্রতিকার পাবেন সেটাই জানতে চাওয়া তার। সংস্থার হেল্পলাইন অফিসার মো. লিমন ইসলাম তাকে জানালেন প্রথমে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে বিষয়টা মীমাংসা করার চেষ্টা করতে। ব্যর্থ হলে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে গেলে তিনি আইনগত সহায়তা পাবেন। প্রতিদিন এমন ১৫০ থেকে ১৬০টি ফোন আসে লিগ্যাল এইড হেল্পলাইনের টোল ফ্রি নম্বরে (১৬৪৩০)। পারিবারিক কলহ, সম্পত্তির ভাগাভাগি, নারী ও শিশু নির্যাতন, সন্তানের অভিভাবকত্বসহ নানা সমস্যা সম্পর্কে জানতে চান ফোনকারীরা।

শুধু হেল্পলাইনের মাধ্যমেই নয়, দরিদ্র ও অসচ্ছল বিচার প্রার্থীদের বিনা খরচে আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা। বিচারিক আদালতে আইনজীবী নিয়োগ করে মামলা পরিচালনা, প্রয়োজনে উচ্চ আদালতেও সংস্থার প্যানেল আইনজীবীদের মাধ্যমে অসচ্ছলদের মামলা লড়ছে সংস্থাটি। অনেক সময় মামলা না করেও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে লিগ্যাল এইড অফিসগুলোতে। শ্রম আদালতে শ্রমিকদের পক্ষে মামলা লড়তেও সহায়তা দেয় সরকারের এ সংস্থা। আজ ২৮ এপ্রিল। জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস। ‘উন্নয়ন আর আইনের শাসনে এগিয়ে চলছে দেশ, লিগ্যাল এইডের সুফল পাচ্ছে সারা বাংলাদেশ’— এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে দিবসটি পালন করা হচ্ছে জাতীয়ভাবে। এ উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ঢাকার পাশাপাশি জেলা ও উপজেলাগুলোতেও দিবসটি উপলক্ষে র‌্যালি, গোলটেবিল আলোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তন প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী লিগ্যাল এইড মেলারও আয়োজন করেছে সংস্থাটি। বিনা খরচে আইনি সহায়তার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্যতম স্বপ্ন ছিল সবার জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার ও সুবিচার নিশ্চিত করা। সে লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০০০ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করেন। এই আইনের আওতায় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে থমকে যায় এই কার্যক্রম। গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার আবার এ কার্যক্রম শুরু করে। সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে এই সেবা পৌঁছে দিতে সরকার কাজ করছে বলেও জানান মন্ত্রী।

এ বিষয়ে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার উপ-পরিচালক (যুগ্ম জেলা জজ) আবেদা সুলতানা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা পৌঁছে দিতে আমরা সব ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। উপজেলা ও ইউনিয়নগুলোতেও লিগ্যাল এইড কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। এর ফলে সরকারি এই সেবাগ্রহীতার হার বেড়েই চলছে। তিনি আরও বলেন, উচ্চ আদালতে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি এবং জেলা আদালতগুলোতে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি ছাড়াও এ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ সেবা জনগণের ঘরে ঘরে নিয়ে যেতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়েও আমাদের লিগ্যাল এইড কমিটি কাজ করছে। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ৩ লাখ ৫৯৮ জন মানুষ এই সেবা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে ২ লাখ ৩৯ হাজার ৪৫৩ জন সেবা গ্রহণ করেছেন। বাকিরা সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটি, শ্রম আদালত ও কল সেন্টার এবং হেল্পলাইনের মাধ্যমে এই সেবা গ্রহণ করেছেন।

হেল্পলাইন : ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টোল ফ্রি এই হেল্পলাইন সেবা কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। যে কোনো ব্যক্তি হেল্পলাইনের ১৬৪৩০ নম্বরে বিনা খরচে ফোন করে প্রাথমিক আইনি পরামর্শ ও সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এ সেবা দেওয়া হয়। তিনজন হেল্পলাইন অফিসার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। এই সেবা উদ্বোধনের দিন থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ২৫ হাজার ৮৮৭ জন এ সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৭ হাজার ৮৮৫ জন নারী ও ১৮ হাজার ৩ জন পুরুষ। লিগ্যাল এইড হেল্পলাইন অফিসার তাসনোভা তাজিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিন নানা সমস্যা নিয়ে মানুষ ফোন করে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সেবা দিয়ে থাকি। এটা ভেবে অনেক ভালো লাগে মানুষের জন্য কাজ করতে পারছি।

বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতেও সাফল্য : আদালতে মামলা পরিচালনার পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমেও সমস্যার সমাধান হয় লিগ্যাল এইড অফিসগুলোতে। ২০১৫ সালে এডিআর সেবা চালুর পর থেকে গত মার্চ পর্যন্ত পাওনাদারদের ৮ কোটিরও বেশি টাকা আদায় করে দিয়েছে সরকারি এই সংস্থাটি।

যাদের জন্য আইনগত এই সহায়তা : জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী, ‘অসচ্ছল বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি’ যে কেউ এ সহায়তা পাবেন। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য ওই ব্যক্তির আয় বছরে গড়ে দেড় লাখ এবং অন্যান্য আদালতের ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকার মধ্যে হতে হবে। এ ছাড়া কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক দেড় লাখ টাকার ঊর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম এমন মুক্তিযোদ্ধা, শিশু, বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মাতা, পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত নারী, এসিডে দগ্ধ নারী বা শিশু, উপার্জনে অক্ষম ও সহায়-সম্বলহীন প্রতিবন্ধী এ সুবিধার অধিকারী হবেন। বর্তমানে লিগ্যাল এইড সেবাগ্রহীতাদের আয়সীমা আয়করমুক্ত সীমার সমান করতে নীতিমালা সংশোধনের কাজ চলছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর