শিরোনাম
শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা
কিম-মুন ঐতিহাসিক বৈঠক

উপদ্বীপে আর যুদ্ধ নয়, শুরু হলো শান্তির যুগ

প্রতিদিন ডেস্ক

উপদ্বীপে আর যুদ্ধ নয়, শুরু হলো শান্তির যুগ

সামরিক উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে বুকে বুক মেলালেন উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মুন জায়ে ইন —এএফপি

কোরীয় দ্বীপে সামরিক উত্তেজনার অবসান ঘটিয়ে গতকাল দুই কোরিয়ার নেতা ঐতিহাসিক বৈঠক করে বিশ্ববাসীকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা প্রেসিডেন্ট কিম জং উন নিজ দেশের সীমান্ত থেকে হেঁটে নো-ম্যান্স-ল্যান্ড পার হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার মাটিতে মিলিত হন প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইনের সঙ্গে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় (বাংলাদেশ সময় ৬.৩০) এই ঐতিহাসিক সম্মিলন ঘটে। সীমান্তে মুন জায়ে ইন স্বাগত জানান কিমকে। পরে আনুষ্ঠানিকতা শেষে দক্ষিণ কোরিয়ার পিস হাউসে আলোচনায় বসেন তারা। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স। ১৯৫৩ সালে কোরীয় যুদ্ধ অবসানের ৬৫ বছর পর এবারই প্রথম কোনো উত্তর কোরীয় রাষ্ট্রনায়ক আলোচনার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছালেন। এর আগে দুই কোরিয়ার নেতারা দুবার আলোচনায় বসলেও সেই আয়োজন হয়েছিল পিয়ংইয়ংয়ে। এবারের বৈঠকের পুরো পরিকল্পনা আগে থেকেই তৈরি করা হয়েছিল। বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন দুই দেশের নেতারা। এরপর ঘোষণা আসে তাদের পক্ষ থেকে। মুন জায়ে ইন বলেন, ‘কিমের সাহস ও ইচ্ছাশক্তির প্রশংসা করি আমি।’ কিম বলেন, ‘আমরা আশাকরি অতীতের ভুল আবার করব না আমরা। আমি আশাকরি দুই কোরিয়ার মানুষের জন্য অবাধে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাতায়াতের একটি সুযোগ। আমাদের ইতিহাসের দায় আমাদেরকেই নিতে হবে।’ সেই সঙ্গে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করে এ বছরই একটি শান্তি চুক্তিতে সই করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকারও এসেছে দুই নেতার কাছ থেকে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, দুই কোরিয়ার শীর্ষ নেতাদের ঐতিহাসিক সম্মেলনের যৌথ ঘোষণায়  কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে একমত হয়েছে। দুই নেতার ঐতিহাসিক বৈঠকে বসার পর এই সিদ্ধান্ত আসে। সংবাদমাধ্যমটি জানায়, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় ঐতিহাসিক সম্মেলনে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে ইন ও উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং উন এক বৈঠকে একমত হন যে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে শান্তিচুক্তি আলোচনায় বৈঠকে বসবেন। আরও জানানো হয়, মানবিক সংকটগুলো সমাধানে জরুরি ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে দুই দেশ। কোরীয় উপদ্বীপে সৃষ্ট সামরিক উত্তেজনা প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন তারা। সেই লক্ষ্যেই মে মাসে দুই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা বৈঠক করবেন। আর ১ মে থেকে বন্ধ হবে লাউডস্পিকার ও লিফলেট বিতরণসহ প্রচারণা কার্যক্রম। দুই পক্ষের যৌথ বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, সামনের শরতেই পিয়ংইয়ং সফরে যাবেন মুন। কিয়াসংয়ে দুই দেশের এক লিয়াজোঁ অফিস স্থাপনে একমত হয়েছেন দুই নেতা। গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, যৌথ ঘোষণায় কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়নি, তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। এতে মূলত উভয় পক্ষের মধ্যে আলোচনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।  কোরিয়া যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পরিবার থেকে শুরু যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে গুরুত্ব পেয়েছে। পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়টি শুধু একটা অংশে বলা হয়েছে এবং তা সাধারণ ধারণা মাত্র। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘দক্ষিণ ও উত্তর নিশ্চিত করছে, কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত রাখার সাধারণ লক্ষ্যের বিষয়ে।’ বিবিসি জানায়, কোরীয় উপদ্বীপকে সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে উভয় নেতা একমত হয়েছেন। এ ছাড়া যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, কোরীয় উপদ্বীপে আর কোনো যুদ্ধ হবে না। ফলে শান্তির এক নতুন যুগের শুরু হবে। বিবিসি আরও জানায়, যুদ্ধের অবসানের জন্য যুদ্ধবিরতির ৬৫তম বার্ষিকীতে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করবে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে উভয় নেতা কোরীয় যুদ্ধের অবসানের অঙ্গীকার করেছেন।

যৌথ ঘোষণার মূল কথা : কিম-মুন বৈঠকের যৌথ ঘোষণার মূলে রয়েছে— ১. দুই কোরিয়া নিজেদের মধ্যে হামলা বা সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করবে, ২. যুদ্ধের প্রচার বন্ধ করে দুই দেশের সীমান্তের ‘ডিমিলিটারাইজড  জোন’কে শান্তির অঞ্চলে পরিণত করবে, ৩. কোরীয় উপদ্বীপের অস্থিরতা কমাতে অস্ত্র কমিয়ে আনা হবে, ৪. যুদ্ধের কারণে দুই দেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পরিবারগুলোর পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করা হবে, ৫. সীমান্তে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হবে, ৬. আসন্ন এশিয়ান গেমসসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রযোগিতায় যৌথভাবে অংশগ্রহণ করা হবে ইত্যাদি।

সংবাদ মাধ্যমের খবর : ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন কিম জন উন। কোরীয় যুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে কিম জন উনই উত্তর কোরিয়ার প্রথম নেতা, যিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। এ সময় তাকে স্বাগত জানান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট। বিবিসি জানিয়েছে, উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের অনুষ্ঠিতব্য সীমান্ত বৈঠকের আগে উভয়কে হাস্যোজ্জ্বল দেখা গেছে। পরে সম্মেলনস্থলে উপস্থিত হয়ে কিম জানান, তিনি উভয় দেশের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা আশা করেন।

কিম জন উন উত্তর কোরিয়া থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে প্রবেশ করার আগে এবং পরে দক্ষিণ কোরিয়ার নেতার সঙ্গে করমর্দন করেন। এ সময় মুন বলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হতে পেরে খুশি।’ আর পানজুনজাম গ্রামের পিস হাউসের গেস্টবুকে কিম জন উন লেখেন, ‘একটি নতুন ইতিহাস রচিত হয়েছে। এখান থেকে শান্তি যুগের শুরু।’

নুডলসের সম্পর্ক : দক্ষিণ কোরীয় সীমান্তের সামরিক সীমারেখায় কিমকে স্বাগত জানানো হয়। সামরিক কায়দায় তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এ সময় কিম জং উন বলেন, ‘আজ আমরা সূচনারেখায় অবস্থান করছি, যেখানে আছে শান্তি ও সমৃদ্ধির নতুন ইতিহাস। আন্তকোরীয় সম্পর্কের সেই ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে।’ নতুন এ সম্পর্ককে ‘নুডলসের’ সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘আশা করি, যে নুডলস আমরা নিয়ে এসেছি, সেটা সত্যিই আপনার ভালো লাগবে।’

হোয়াইট হাউসের আশা : দুই কোরিয়ার সম্পর্কের অগ্রগতি দেখে হোয়াইট হাউস বলেছে, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা আশাপ্রদ ছিল। কোরীয় সম্মেলনের মাধ্যমে আগামী জুনের শুরুর দিকে কিম ও  প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে বৈঠকে বসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। উত্তর কোরিয়ার এই নেতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের  প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হয়নি। তাই আসন্ন বৈঠকের বিষয়টি অভূতপূর্বই বটে। খবরে বলা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি ট্রাম্প-কিম বৈঠকের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। এরই ধারাবাহিকতায় কিম-মুন বৈঠকের পর ট্রাম্প-কিম বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন উত্তর কোরিয়ার দীর্ঘদিনের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং। গোপন সফরে চীন থেকে ফিরে কিমও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে আপাতত পরমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর