শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি ঠেকানো যাচ্ছে না

শিমুল মাহমুদ

কোনো প্রচেষ্টাতেই ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধের বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। কার্যকর তদারকি ও পদক্ষেপের অভাবে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে ওষুধ খাতে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি ওষুধের সুনাম এবং রপ্তানি সাফল্যের পরও দেশ জুড়ে এই নজিরবিহীন নৈরাজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। ওষুধ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে রোগীরা নির্ভর করছেন কমিশননির্ভর ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের ওপর। অন্যদিকে সেই ডাক্তাররা নিজেদের খেয়াল খুশিমতো ওষুধ কোম্পানিগুলোর চাপিয়ে দেওয়া ওষুধ লিখে দিচ্ছেন রোগীর প্রেসক্রিপশনে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর দাবি, গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওষুধের প্রচারের সুযোগ না থাকায় তারা ‘মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ’ দিয়ে ওষুধের মার্কেটিং করান। এর ফলে ওষুধের প্রচার না থাকায় ক্রেতারা জেনে বুঝে তার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধটি কিনতে পারছেন না। তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্ধের মতো অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের অকার্যকর ওষুধ কিনতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সম্প্রতি দেশব্যাপী ‘মডেল ফার্মেসি’ কার্যকরের উদ্যোগ নিলেও সিন্ডিকেটের তৎপরতার কারণে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিপণন ঠেকানো যাচ্ছে না। সম্প্রতি কুরিয়ার সার্ভিসে নকল ও ভেজাল ওষুধ বিপণনের একটি চক্র র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছে।

সূত্র জানায়, দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ওষুধ বিপণন নিয়ে এক অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলছে। নতুন ওষুধ বাজারজাত করার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ না থাকায় কোম্পানিগুলো নির্ভর করছে মেডিকেল প্রমোশন কর্মীদের ওপর। ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে ওষুধ বিপণনে প্রচারের সুযোগকে আইন করে রহিত করা হয়। পাশাপাশি আইন লঙ্ঘন করে ওষুধের বিজ্ঞাপন দিলে ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এই প্রতিবন্ধকতার ফলে বিকল্প পন্থায় নিজেদের অনুকূলে ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় কোম্পানিগুলো। বড় কোম্পানিগুলোর এই তৎপরতার পাশাপাশি সক্রিয় ছোট কোম্পানিগুলোও। পিছিয়ে নেই ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রেতারা। নগর, শহরের বাইরে অপেক্ষাকৃত প্রত্যন্ত অঞ্চল, বস্তি ও গার্মেন্ট এলাকার ওষুধের দোকানগুলোতে ছোট কোম্পানির ওষুধ বেশি বিক্রি হয়। ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধও বিক্রি হয় এসব এলাকাতেই। কারণ, ওষুধ সম্পর্কে ক্রেতাদের ন্যূনতম ধারণা না থাকার সুযোগ নিয়ে হাতুড়ে চিকিৎসক ও ওষুধের দোকানদাররা নিম্নমানের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছেন রোগীদের।

এদিকে ওষুধ বাজারে নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রায় নিয়মিতই ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে যথেচ্ছহারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে বিক্রি করে ফার্মেসিগুলো। জনস্বাস্থ্য গবেষকরা জানান, ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন বন্ধ করা যাবে না। বাড়তি মুনাফার জন্য ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের অতিরিক্ত দাম নির্ধারণ না করলে নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি কমে যেত। সূত্র জানায়, ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতে আইন করে পত্রিকায় ওষুধের বিজ্ঞাপন বন্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল, রেজিস্টার্ড ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কেনাবেচা রোধ করা। মানুষ যেন নিজের ডাক্তারি নিজেই না করে বসেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই আইনের উদ্দেশ্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। দেশে চিকিৎসকদের পরামর্শপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রির প্রবণতা বাড়ছেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক দেশজুড়ে একটি জরিপ করে দেখেছেন, ৮৭ শতাংশ ক্ষেত্রেই ওষুধের দোকানগুলোতে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বেচাকেনা হয়। নতুন বাজারজাত করা ওষুধের প্রচারের ব্যবস্থা থাকলে ভোক্তাদের ডাক্তার ও ফার্মেসিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হতো না। সূত্র জানায়, ওষুধ বাজারে সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দেশের ফার্মেসিগুলোতে নিয়মিত বিক্রি হচ্ছে ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ। খোদ রাজধানী ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতেও ভেজাল ও নকল ওষুধের কারখানা গড়ে উঠেছে। পুলিশি অভিযানে এসব কারখানা বন্ধ হলেও ঠিকানা পাল্টে পুরনো উদ্যোক্তারাই আবার ভেজাল ও নকল বাণিজ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝেই অভিযান চালিয়ে এসব কারখানার মালিক কর্মচারীদের আটক করে র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে দ্রুতই তারা বেরিয়ে এসে পুরনো অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। জানা গেছে, ওষুধ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও ভেজাল ও নকল চক্র কার্যকরভাবে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না। সাময়িক শাস্তি শেষে ভেজাল চক্রের উদ্যোক্তারা আবার আস্তানা পাল্টে নতুনভাবে পুরনো ব্যবসায় ফিরে আসে। ওষুধ প্রশাসন নকল ও ভেজালের দায়ে ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করলেও সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটি আবার ভেজালের দায়ে ধরা পড়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে যত ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয় তার শতকরা ৩৫ ভাগ তৈরি হয় ভারতে। এর বার্ষিক বাজার মূল্য ৪০০০ কোটি রুপি। এটি ভারতের মোট ওষুধের বাজারের শতকরা ২০ ভাগ। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শতকরা ২৩ ভাগ ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করে নাইজেরিয়া। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের পরিমাণ তাদের মোট উৎপাদিত ওষুধের শতকরা ১৫ ভাগ, যার বার্ষিক বাজার মূল্য ১৬০০ কোটি টাকা। একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১০০০ কোটি টাকা, যা মোট বিক্রির প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। সূত্র জানায়, দেশের বৃহত্তম ওষুধ বাজার পুরান ঢাকার মিটফোর্ড মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থানে ওষুধের দোকানে বিক্রি হচ্ছে নকল ও নিম্নমানের ওষুধ। এসব ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। সম্প্রতি নোয়াখালী থেকে ঢাকার বাবুবাজার এলাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে একটি ওষুধের চালান পাঠানো হয়েছিল। কুরিয়ার সার্ভিস কার্যালয়ে সেই কার্টন খুলে পাওয়া যায় নকল ‘সেকলো’ ক্যাপসুলের প্যাকেট। পরে পুলিশ ওষুধ জব্দ করে নিয়ে যায়। নকল ওষুধের চালান জব্দের খবর পেয়ে এ ব্যাপারে অনুসন্ধ্যান করে পুলিশ-র‌্যাব ও ওষুধ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা জানান, এসব নকল ওষুধ কোথায় তৈরি হয় তা খুঁজে দেখা হচ্ছে।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি চক্র কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওষুধ সরবরাহ করছে। গত বছর মতিঝিলে কুরিয়ারে আসা একটি নকল ওষুধের কার্টন জব্দ করা হয়েছিল। এবার জব্দ হওয়া ওষুধগুলো প্রাথমিক পরীক্ষায় নকল বলে শনাক্ত হয়েছে। স্কয়ারের প্রতিনিধিও ওষুধ দেখে জানিয়েছেন এগুলো তাদের প্রতিষ্ঠানের তৈরি নয়। তাছাড়া নোয়াখালীতে তাদের কোনো কারখানা নেই যে, সেখান থেকে ওষুধ সরবরাহ করা হবে।

সর্বশেষ খবর