রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বেপরোয়া বাসচালক, আবার গেল পা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেপরোয়া বাসচালক, আবার গেল পা

বাসের ধাক্কায় গতকাল পা হারানো তরুণ —বাংলাদেশ প্রতিদিন

এবার রাজধানীতে বাসের চাকায় পা হারিয়েছেন এক প্রাইভেটকার চালক। গ্রীন লাইন পরিবহনের একটি বাস গতকাল রাজধানীর ধোলাইপাড় থেকে দ্রুত গতিতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠার সময় একটি প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেয়। তখন গতি কমায় বাস ও প্রাইভেটকার। প্রাইভেটকার থেকে চালক রাসেল ও সোহাগ নেমে আসেন। থামতে বলেন বাসকে। কিন্তু বাস চালক কবির গাড়ি চালিয়ে দেন চালক রাসেলের পায়ের ওপর।

গতকাল বেলা ৩টার দিকে ফ্লাইওভারের ধোলাইপাড় ঢালের ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে জানা গেছে, রাসেল গ্রীন লাইন পরিবহনের চালককে বলেন, ‘ভাই, আপনি চাপা দিয়ে আমার প্রাইভেটকারটি কি করেছেন? একটু নেমে দেখেন।’ গ্রীন লাইন চালক রাসেলের কথার কোনো উত্তর দিচ্ছিলেন না। তিনি গাড়িটি এগিয়ে নিতে থাকেন। এ সময় রাসেল চালককে বলেন, ‘বাস থেকে না নামলে কাঁচ ভেঙে দেব।’ গ্রীন লাইনের চালক কবির গাড়িটি রাসেলের দিকে চালিয়ে দেন। রাসেল ফ্লাইওভারের রেলিংয়ের সঙ্গে আটকে পড়ার ভয়ে এককোণে চলে যান। গ্রীন লাইন চালকও বাসটিকে সেদিকে নিয়ে যান। রাসেল সে পাশ থেকে পূর্ব পাশে চলে আসেন এবং বলতে থাকেন, ‘না নামলে এবার কিন্তু সত্যি গাড়ির কাচ ভেঙে দেব।’ কবির এবার তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করলে ফ্লাইওভারের রেলিংয়ে আটকা পড়েন রাসেল। দেহটি সরাতে পারলেও গাড়িটি তখন বাম পায়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হয়। পাটি রেলিংয়ের সঙ্গে ঠেকে যায়। এতে গাড়ির চাকার চাপে পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। আর রাসেলের দেহটি রেলিংয়ের বাইরের রাস্তায় পড়ে যায়। চোখের সামনে এমনটি ঘটলেও কারও কিছু করার ছিল না। ঘটনাটি দেখে এবং রাসেলের চিৎকারে লোকজন ছুটে আসেন। সবাই তখন রাসেলকে উদ্ধার করে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাসেলকে স্কয়ার হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। রাসেল এপিআর এনার্জি বিদ্যুৎ প্রজেক্টের গাড়ি চালাতেন। সোহাগ বলেন, ‘রাসেলকে চাপা দিয়েই চালক দ্রুত গতিতে গাড়িটি চালিয়ে ফ্লাইওভার হয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি দ্রুত একটি মোটরসাইকেল নিয়ে পিছনে একজনকে বসিয়ে বাসটির পিছু ছুটি। এসে ফ্লাইওভারের টোল প্লাজায় (চাঁনখারপুল সংলগ্ন) বাসটিকে আটক করি। টোল প্লাজায় থাকা লোকজনকে বলি, এই বাস চালক একজনকে চাপা দিয়ে পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আপনারা বাসটি আটক করেন। কিন্তু তারা বলেন, আমরা আটক করতে পারি না। আপনারা নিচে গিয়ে (ফ্লাইওভার থেকে নামলে) পুলিশকে বলেন।’ সোহাগ তখন মোটরসাইকেল টান দিয়ে চাঁনখারপুল ফ্লাইওভারের গোড়ায় এসে পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু গ্রীন লাইন চালক চাঁনখারপুল দিয়ে না গিয়ে কৌশলে আনন্দ বাজার সংলগ্ন ক্রসিং হয়ে বেরিয়ে আসেন। চাঁনখারপুলে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশ সোহাগকে বলেন, ‘চালক তো গাড়ি নিয়ে এখান দিয়ে আসেনি। আনন্দ বাজার মোড় হয়ে চলে গেছে। আপনি গিয়ে সেখানকার দায়িত্বে থাকা পুলিশকে বিষয়টি বলেন।’ সোহাগ সেখান থেকে ছুটে আসেন আনন্দবাজার মোড়ে। সেখানকার দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশকে বললে তারা ওয়াকিটকির মাধ্যমে পুলিশকে বিষয়টি জানায়। বাসটি বঙ্গবাজার ও ঢাবির ফজলুল হক হলের সামনে দিয়ে হাই কোর্ট মোড়ে আসে। সোহাগরাও সেই পথে এসে দেখেন ট্রাফিক পুলিশ বাসটিকে আটক করেছে। সোহাগের সঙ্গে গাড়িটির পিছু নেওয়া আরেক প্রত্যক্ষদর্শী আকাশ বলেন, ‘ধোলাইপাড়ে ঘটনাটি ঘটার সময় বাসে কোনো যাত্রী ছিল না। চালক, হেলপার ও কন্ডাক্টর ছিল। হাই কোর্ট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ যখন বাসটি আটক করে তখন শুধু চালক ছিল। পরে গাড়িসহ এর চালককে শাহবাগ থানা পুলিশ নিয়ে যায়।’ এদিকে বেশ কয়েকজন রাসেলকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে প্রত্যক্ষদর্শী মাশরুর অন্যতম। তার এক হাতে রাসেলের বিচ্ছিন্ন হওয়া পা, আরেক হাত দিয়ে রাসেলকে ধরে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন। সেখানে রাসেল সাংবাদিকদের বলেন, একটি কোম্পানি তার গাড়িটি ভাড়া করেছিল। ওই কাজ শেষ করে কেরানীগঞ্জ থেকে তিনি ঢাকায় ফিরছিলেন। ফেরার সময় যাত্রাবাড়ীতে গ্রীন লাইন পরিবহনের একটি বাস তার গাড়িকে ধাক্কা দেয়। পরে গাড়ি থামিয়ে বাসের সামনে গিয়ে বাসচালককে নামতে বলেন তিনি। শুরু হয়ে যায় বাসের চালক ও রাসেলের মধ্যে কথা-কাটাকাটি। এ সময় গ্রীন লাইন পরিবহনের চালক বাসটি বারবার তার দিকে নিচ্ছিল।

ভয়ে তিনি একবার পশ্চিম পাশে আবার পূর্ব পাশে সড়ে যান।

এভাবে কয়েকবার করার পর চালক রেলিংয়ের সঙ্গে বাসটি দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে দেয়। এতে তিনি আটকা পড়লে বাসের চাকা তার বাম পায়ের ওপর উঠিয়ে দেয়। আতঙ্কিত কণ্ঠে এসব কথাগুলো বলছিলেন রাসেল। কিছুক্ষণ থেমে থেমে পরক্ষণে বলেন, ‘অয় (গ্রীন লাইন চালক) চেয়েছিল গাড়ি চাপা দিয়ে রাস্তায় আমাকে পিষে ফেলতে। তাই বার বার আমাকে চাপা দিতে চেয়েছিল!’

রাসেলের সহকর্মী আরিফ জানান, রাসেল ‘সাগর রেন্ট-এ-কার’ নামে একটি কোম্পানি থেকে গাড়ি নিয়ে চালাতেন। মূলত তিনি নোয়া গাড়ির চালক ছিলেন। গাড়িটি ব্যক্তিগতভাবেই চালাতেন। তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি উপজেলার পার্বতীপুর গ্রামে। ঢাকায় আদাবর ১০ নম্বর রোডের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকেন।

আরিফ বলেন, স্কয়ার হাসপাতালের ওটিতে রাসেলের বিচ্ছিন্ন হওয়া পাটিও নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা পাটি জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছেন।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জানান, চালক কবির হোসেনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। বাস ও চালককে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত ৩ এপ্রিল বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাস চাপায় হাত ও জীবন হারাতে হয়েছে সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনকে। এরপর ২০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টার দিকে বনানীর চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে বিআরটিসির আরেকটি বাসের ধাক্কায় পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গৃহকর্মী রোজিনা আক্তারের। এরপর গোপালগঞ্জে ট্রাকের চাপায় হাত হারান পরিবহন শ্রমিক হৃদয়। শুধু রাজীব, রোজিনা কিংবা হৃদয় নয়; সড়কে এভাবে প্রতিনিয়ত কাউকে না কাউকে হাত/পা হারাতে হচ্ছে। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে পাল্লা দিয়ে।

সর্বশেষ খবর