শিরোনাম
সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

নতুন সিদ্ধান্ত আসছে নিরাপত্তা পরিষদের

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে রোমহর্ষক বর্ণনা শুনল প্রতিনিধি দল

কূটনৈতিক প্রতিবেদক ও কক্সবাজার প্রতিনিধি

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-ধর্ষণ-নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমরা গতকাল পরিদর্শনরত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দলের সামনে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। পরে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে এসেছে। এ সমস্যা মিয়ানমারেরই সৃষ্ট। তাই মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। তবে নিরাপত্তা পরিষদ এক্ষেত্রে কী করতে পারে- সে বিষয়ে সফর শেষে ফিরে গিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গতকাল সকাল সোয়া ৯টার দিকে ৩০ সদস্যের প্রতিনিধি দলটি নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রুর কোনারপাড়া জিরো পয়েন্ট এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে তারা দুপুর ১টা পর্যন্ত অবস্থান করেন এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা চারটি দলে ভাগ হয়ে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের মুখ থেকে নির্যাতনের বর্ণনা শোনেন। শূন্যরেখা থেকে ফিরে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা উখিয়ার বালুখালী-০২ ময়নারঘোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। পরে তারা কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ পরিদর্শনের সময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ও কক্সবাজারে বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক  লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রেজেন্টেশন দেন। উচ্চপর্যায়ের এ প্রতিনিধি দলকে কাছে পেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা তাদের ওপর মিয়ানমারে চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা তাদের অবস্থান থেকে এ ঘটনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখার আশ্বাস দেন রোহিঙ্গাদের। শেষে কুতুপালং ডি ব্লকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা। প্রতিনিধি দলের নেতা পেরুর গুস্তাভো মেজা শুয়াদ্রা বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার জন্য এখানে এসেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত, ধর্ষিত, মানসিক আঘাতপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা এই শরণার্থী সংকট দেখে খুবই উদ্বিগ্ন। পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। রোহিঙ্গাদের জন্য যাতে কিছু করতে পারি, সে জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আমাদের অভিজ্ঞতা পেশ করব। সেখান থেকেই পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে আমরা সহযোগিতা করে যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের অবশ্যই নিজ দেশে  ফেরত যেতে হবে এবং তাদের নিরাপদ জীবন দিতে হবে। এখন যে পরিস্থিতি রয়েছে, তা রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযোগী নয়। তাই এ প্রক্রিয়ায় কিছুটা বিলম্ব হতে পারে।’ কুয়েতের প্রতিনিধি মানসুর আল ওতাইবি বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ও এ দেশের জনগণ রোহিঙ্গাদের যে সহযোগিতা করেছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।’  তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখান থেকে মিয়ানমারে যাব এবং সেখান থেকে নিউইয়র্কে গিয়ে বিষয়টি নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনা করব।’ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে। মিয়ানমারকেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে নিরাপদে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।’ রোহিঙ্গাদের বিষয় নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার প্রতিনিধি দিমিত্রি পোলিয়ানস্কি বলেন, ‘রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বুঝতে এ সফর অত্যন্ত সহায়ক হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাস্তবিক অবস্থা কেমন, সেটি জানতে সহকর্মীদের সঙ্গে আমি এ সফরে এসেছি।’ তিনি এও উল্লেখ করেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখনো একটি বিতর্কিত বিষয়।’ একই প্রশ্নের উত্তরে নিরাপত্তা পরিষদে চীনের প্রতিনিধি উ হাইতাও বলেন, ‘এ সমস্যা যে বাংলাদেশের জনগণকে কতটা প্রভাবিত করছে, তা আমরা বুঝতে পারছি। আমরা মনে করি, এ সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান দরকার দুই দেশের মধ্যেই। সমস্যার সমাধানে মানবিক দিকটি বিবেচনা করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে শুরু থেকেই চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে।’ তিনি এও উল্লেখ করেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই।’ এ সময় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে থাকা পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক মহল অনুধাবন করতে পেরেছে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের জন্য সৃষ্টি হয়নি। রোহিঙ্গা সংকটের কারণ মিয়ানমার। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদ ঐকমত্য পোষণ করেছে। প্রত্যাবাসনেও যদি ঐকমত্য হয় তাহলে সহজে সমস্যার সমাধান হবে। এ সময় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আরও ছিলেন শরণার্থী সচিব আবুল কালাম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এ এইচ এম মনিরুজ্জামান, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন, জেলা পুলিশ সুপার ড. এ কে ইকবাল হোসেন, উখিয়া সার্কেল চাই লাউ মারমা, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান, উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি একরামুল ছিদ্দিক ও উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের। এদিকে কুতুপালং শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলটি ক্যাম্প ত্যাগ করার সময় শত শত রোহিঙ্গা নারী-শিশু ও পুরুষ বিভিন্ন ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে মিয়ানমারবিরোধী মিছিল করে। অন্যদিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দলটির আগমনে সকাল থেকে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। অন্যান্য দিনের তুলনায় যানবাহন কম ছিল। গত শনিবার বিকালে সরাসরি বিমানে কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছানো ৩০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি গতকাল বিকাল ৩টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে বিমানযোগে কক্সবাজার ত্যাগ করে। পরে রাত সাড়ে ৭টার কিছু পরে তাদের সম্মানে ঢাকার হোটেল র‌্যাডিসনে আয়োজিত নৈশভোজের আয়োজন করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা। মিয়ানমারে তাদের দুই দিনের সফরে রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের কথা রয়েছে।

সর্বশেষ খবর