মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

চার সশস্ত্র সংগঠনের বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে পাহাড়ে খুনোখুনি

বছরে চারশত কোটি টাকার চাঁদা
অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার

শিমুল মাহমুদ

তিন পার্বত্য জেলায় চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, গোলাগুলি, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন নাশকতা ঘটছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর হুমকির মুখে সন্ত্রস্ত পাহাড়ি-বাঙালি পেশাজীবীরা। অস্ত্রের মুখে চার সংগঠন বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি থেকে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে। এজন্য তারা অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছে। পাবর্ত্য শান্তিচুক্তির আওতায় বেশির ভাগ সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এসব সন্ত্রাসী সংগঠন আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে জানা গেছে। সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের পর থেকে সেসব এলাকায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। উল্লেখ্য, শান্তিচুক্তির আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট সেনা ও বিজিবির ক্যাম্প ছিল ৫৫২টি। চুক্তির পর দুর্গম পার্বত্য এলাকা থেকে ৩৩৪টি ক্যাম্প সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেনাক্যাম্প আছে ২১৬টি। সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারের কারণে অনেক জনপদ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি রাঙামাটিতে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ছয়জনের খুনের ঘটনায় পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তার, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। পাহাড়ের অভ্যন্তরীণ এই রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পরও পার্বত্যবাসীর অধিকার নিয়ে সর্বদা মুখর রাজধানীকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা মুখ খুলছেন না। সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন অংশে তিনটি আঞ্চলিক সংগঠন নিজস্ব স্বার্থ সামনে রেখে আধিপত্য বিস্তার করত। সংগঠনগুলো হলো, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও জনসংহতি সমিতি সংস্কারবাদী (এমএন লারমা)। গত বছরের ১৫ নভেম্বর ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক আত্মপ্রকাশের পর থেকেই মূলত তিন পার্বত্য জেলায় অঞ্চলভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে গেল ৪ মে পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ মাসে খুন, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, গুলিবিনিময়সহ মোট ৫১টি ঘটনা রেকর্ড করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৮টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে এপ্রিলে। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবারের ছয় খুনসহ সাড়ে পাঁচ মাসে চার সশস্ত্র গ্রুপের দ্বন্দ্বে ২৪ জন খুন হয়েছেন। অপহরণ করা হয়েছে ৩৬ জনকে। গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। এ সময় অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ৬৮ ইউনিট। গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে ২ হাজার ৩৭১টি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, পার্বত্য শান্তিচুক্তির আলোকে সরকার সেনাক্যাম্প প্রত্যাহারসহ বিভিন্ন শর্ত পূরণ করলেও সেই সময়ের শান্তিবাহিনীর মূল শক্তির অস্ত্র সমর্পণ কার্যকরভাবে হয়নি। জনসংহতি সমিতির সদস্যরা সরকারের দেওয়া সব ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু তাদের সশস্ত্র অবস্থান ত্যাগ করেননি। বরং নতুন করে তারা ও তাদের প্রতিপক্ষ গ্রুপগুলো বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। প্রতিটি সশস্ত্র গ্রুপই যার যার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে। প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, অপহরণ-চাঁদাবাজি, গুম-খুনসহ সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধিতে অত্যাধুনিক ভারী আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করেছে পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা। আঞ্চলিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় এসব সন্ত্রাসী নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠে বর্তমান সময়ে প্রতিদিনই সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, তিন পাবর্ত্য জেলায় চারটি সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যের হাতে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার অস্ত্র রয়েছে। তাদের কাছে ইউএস আর্মির ব্যবহার করা এম-১৬ আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে। এ ছাড়া একে-৪৭, একে-২২, মেশিনগান, চাইনিজ আর্মস পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের আরাকান আর্মিসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। সূত্র জানায়, চার সংগঠনের অন্তত ৩ হাজার আর্মস ক্যাডার সক্রিয় রয়েছে। সেমি আর্মস ক্যাডার মিলিয়ে পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। তবে সেমি আর্মস ক্যাডার সদস্যরা এলাকাভিত্তিক টোল কালেক্টর হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। সূত্র জানায়, পাহাড়ের বেশকিছু যুবক মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্তের একটি বড় দুর্গম অংশ কোনো প্রতিরক্ষা ক্যাম্প ছাড়াই চলছে। বিজিবি বর্তমানে সীমান্ত এলাকা দিয়ে সীমান্ত সড়ক তৈরি করছে। এর ফলে বর্ডারে টহলের সীমাবদ্ধতা দূর হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো দিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো ভারী অস্ত্র সংগ্রহ করছে। পাহাড়ের বিভিন্ন স্তর থেকে আদায় করা চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকা খরচ করেই এসব অস্ত্র সংগ্রহ করছে সন্ত্রাসীরা। অঞ্চলভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারে এসব অস্ত্র পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে তারা। এদিকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সেনাক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেওয়ার কারণে পাহাড়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিচরণ ক্ষেত্র বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট সূত্র। সূত্র জানায়, সেনাক্যাম্পের জায়গাগুলো ইউপিডিএফ বা অন্যরা দখল করে নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ব্যাপ্তি ঘটিয়েছে। তারা অস্ত্রের জোগান বাড়িয়েছে। আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র তৎপরতার কারণে তিন পার্বত্য জেলায় জাতীয় রাজনীতির কোনো প্রভাব পড়ছে না।

রাঙামাটিতে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল শুরু : ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি থেকে জানান, সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বাঙালি গাড়িচালক সজীব হাওলাদারের হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও খাগড়াছড়িতে অপহৃত তিন বাঙালিকে উদ্ধারের দাবিতে পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও পার্বত্য নাগরিক পরিষদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালে গতকাল প্রথম দিন ছিল শান্তিপূর্ণ। ভোর থেকে হরতালের সমর্থনে মাঠে নামেন পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদ ও নাগরিক পরিষদের নেতা-কর্মীরা। রাঙামাটি শহরের বনরূপা, পৌরসভা, তবলছড়ি ও রিজার্ভ বাজার, কলেজ গেট ও মানিকছড়ি এলাকায় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে পিকেটিং করতে দেখা যায় সংগঠনটির নেতা-কর্মীদের। রাঙামাটি শহরে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সব যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। দোকানপাট খোলেনি। নৌপথে ছেড়ে যায়নি কোনো লঞ্চ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। অফিস-আদালত খোলা থাকলেও মানুষের উপস্থিতি ছিল কম। উল্লেখ্য, ৪ মে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় মাইক্রোচালক সজীব হাওলাদাসহ পাঁচজনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ ছাড়া ১৬ এপ্রিল খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে তিন বাঙালি ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো সন্ত্রাসী গ্রেফতার না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ দেখা দেয় স্থানীয় বাঙালি সংগঠনগুলোর মধ্যে।

খাগড়াছড়িতে পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতি : মো. জহুরুল আলম, খাগড়াছড়ি থেকে জানান, রাঙামাটির নানিয়ারচরে ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাস নিয়ে যাওয়ার পথে বেতছড়িতে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত চালক সজীবের হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে ১২ ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছেন খাগড়াছড়ি পরিবহন শ্রমিকরা। গতকাল কর্মবিরতি পালনকালে শহরের পৌর টাউন হলের সামনে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা মালিক-শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সম্পাদক মো. ইউনুস মিয়া, খাগড়াছড়ি রেন্ট-এ-কার চালক সমিতির সহসভাপতি মো. খাইরুল ইসলাম।

সর্বশেষ খবর