শুক্রবার, ১১ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

অপেক্ষা আরও বাড়ল

নিজস্ব প্রতিবেদক

অপেক্ষা আরও বাড়ল

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারে উৎক্ষেপণের আগে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট —স্পেসএক্স

মহাকাশে যাত্রায় বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্বাপ্নিক এক ইতিহাস গড়ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণের সময়সূচি ছিল নির্ধারিত। তবে শেষ মুহূর্তে কয়েক দফা সময় পেছানো হয়। গত ভোর রাত ৩টা ৪৭ মিনিটে উৎক্ষেপণের প্রস্তুতি নিয়েও আবার পিছিয়ে দেওয়া হয়। ৪টায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় উৎক্ষেপণের আবারও প্রস্তুতি চলছিল। শেষ পর্যন্ত সম্ভব না হলে আজ আবার একই সময়সীমায়   উৎক্ষেপণের কথা রয়েছে। সব ঠিক থাকলে ১০ দিন পর মহাকাশের নির্ধারিত ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে পৌঁছবে বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক বঙ্গবন্ধু-১। ৩০ দিন পর পাওয়া যাবে পূর্ণাঙ্গ সেবা। ৩ দশমিক ৭ টন ওজনের কৃত্রিম স্যাটেলাইটটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ২২ হাজার মাইল ওপরে অবস্থান করে প্রায় ৪০ ধরনের সেবা দিয়ে যাবে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলে। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের মালিক বাংলাদেশ। জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘটনা ঘটলেও দেশজুড়েই ছিল সাজ সাজ রব। বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স বাংলাদেশের এই গর্ব উৎক্ষেপণ সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশিদেরও সুযোগ করে দিয়েছে অংশীদার হওয়ার।  জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমেও এটি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। অবশ্য শুধু টেলিভিশনের পর্দায় নয়, সরাসরি কেনেডি স্পেস সেন্টারের দুটি স্থান থেকে উৎক্ষেপণ দেখতে কয়েক দিন ধরেই ভিড় করে ছিলেন বাংলাদেশিরা। উৎক্ষেপণ মুহূর্তের সাক্ষী হতে প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ছিল কেনেডি স্পেস সেন্টারের মূল ভবনে। উৎক্ষেপণস্থল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরত্বের এই স্থানে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে চালিকাশক্তির ভূমিকায় থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে এ সময় অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ ও প্রকল্প পরিচালক মেজবাহুজ্জামানসহ ৩০ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এ ছাড়া উেক্ষপণস্থল থেকে ৬ দশমিক ২৭ কিলোমিটার দূরত্বের অ্যাপোলো সেন্টার থেকেও উৎক্ষেপণ দেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার আগে প্রকল্প পরিচালক মেজবাহুজ্জামান জানিয়েছেন, এই স্যাটেলাইটটির বহনকারী প্রায় সাত টন ওজনের রকেট সোজা আকাশে উঠে যাবে। দুটি পর্যায় শেষে এটি কার্যকর হবে। এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে উৎক্ষেপণ ও প্রাক্-কক্ষপথ (এলইওপি) এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে কক্ষপথে স্যাটেলাইটটি বসানোর কাজ। কক্ষপথে যাওয়ার আগে এটিকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার যেতে হবে। প্রথম পর্যায়টি সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ১০ দিন। দ্বিতীয় পর্যায়টি সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ২০ দিনের মতো। স্যাটেলাইটটি কার্যকর হওয়ার পর এর নিয়ন্ত্রণ যাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও কোরিয়ায় অবস্থিত তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশনে। এ তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন স্যাটেলাইটটি নিয়ন্ত্রণ করে একে ৩০০ কিলোমিটার দূরে কক্ষপথের ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমায় নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করবে। তবে ফ্যালকন রকেটের চারটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে রয়েছে স্যাটেলাইট এবং এরপর অ্যাডাপটর। অ্যাডাপটরের নিচের অংশটিকে বলা হয় স্টেজ-২ এবং শেষের অংশকে বলা হয় স্টেজ-১। শুরুতে প্রচণ্ড গতিতে রকেটটি আকাশের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় আগুনের গোলা দেখা যাওয়ার কথা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে যাওয়ার পর রকেটের স্টেজ-১ খসে পড়বে। এরপর স্টেজ-২ রকেটটিকে নিয়ে যাবে ৩৫ হাজার ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। কক্ষপথে পৌঁছানোর আগে একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা হবে স্যাটেলাইটটিকে। যখন এটি সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে তখন এর নিয়ন্ত্রণভার হস্তান্তর করা হবে বাংলাদেশে অবস্থিত গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোতে। বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ জানান, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে বাংলায় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানটি লেখা রয়েছে। এই স্লোগান নিয়েই কক্ষপথের দিকে ছুটবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মহাকাশে উৎক্ষেপণে প্রস্তুত হওয়া বঙ্গবন্ধু-১ কক্ষপথে পৌঁছলে বাংলাদেশের দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিভিশন সেবা ডিটিএইচ (ডিরেক্ট টু হোম) ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইট কাজে লাগানো যাবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণও করা সম্ভব হবে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, এই স্যাটেলাইটের আওতায় আসবে সার্কভুক্ত সব দেশ, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও কাজাখস্তানের কিছু অংশ।

দীর্ঘ কর্মযজ্ঞের ফল : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে স্যাটেলাইটের স্বপ্ন দেখলেও বাংলাদেশে স্যাটেলাইট নিয়ে প্রথম কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নে (আইটিইউ) আবেদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের ওই আবেদনের ওপর ২০টি দেশ আপত্তি জানায়। এ আপত্তির বিষয়টি এখনো সমাধান হয়নি। এরপর ২০১৩ সালে রাশিয়ার ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের বর্তমান কক্ষপথটি কেনা হয়। পরে শুরু হয় স্যাটেলাইট তৈরির কর্মযজ্ঞ। পুরো প্রক্রিয়া দেশের বাইরে হলেও এর বাস্তবায়ন হয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তত্ত্বাবধানে। তিনটি ধাপে এ কাজ হয়েছে। এগুলো হলো—স্যাটেলাইটের মূল কাঠামো তৈরি, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপপণ ও ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। স্যাটেলাইট তৈরির কাজ শেষে ৩০ মার্চ এটি উৎক্ষেপণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাঠানো হয়। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের ‘ফ্যালকন-৯’ রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে রওনা দেয়।

অনুমিত ব্যয়ের তুলনায় খরচ কম : দেশের প্রথম এ স্যাটেলাইট তৈরিতে খরচ ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা বাংলাদেশ সরকার ও বাকি ১ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। এ ঋণ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংক এইচএসবিসি। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

নিয়ন্ত্রণ হবে বাংলাদেশেই : ‘জিওস্টেশনারি কমিউনিকেশন’ ধরনের স্যাটেলাইটটি তৈরি থেকে উৎক্ষেপসহ সব প্রক্রিয়া দেশের বাইরে হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ হবে বাংলাদেশ থেকেই। গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি করা গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। বিকল্প হিসেবে থাকবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন। প্রায় ১৫ বছর মিশনের ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন থেকে শুরু করে বাংলাদেশ-ভারত হয়ে তাজিকিস্তান পর্যন্ত ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করবে স্যাটেলাইটটি।

আর্থিক লাভের পাশাপাশি বড় প্রাপ্তি ভাবমূর্তি : প্রায় ৪০ ধরনের সেবা দেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এর মাধ্যমে প্রথমত, সক্ষমতা বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও সাশ্রয় দুটিই করা যাবে। দ্বিতীয়ত, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট ও টেলিযোগাযোগ সেবার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। তৃতীয়ত, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় দারুণ কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই স্যাটেলাইট। এ ছাড়া জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও এ স্যাটেলাইট কাজে লাগানো সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বা সক্ষমতা অন্য দেশের কাছে ভাড়া দিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার সুযোগ থাকবে। এ স্যাটেলাইটের ৪০টি ট্রান্সপন্ডারের মধ্যে ২০টি ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হবে বলে সরকার থেকে বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে এই স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিক্রির জন্য সরকারের গঠন করা বঙ্গবন্ধু কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি (বিসিএসবি) লিমিটেড কাজ শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের আরেকটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য হবে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ। তবে এসব সম্ভাবনাকে ছাড়িয়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, সেটি হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি।

টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধনের প্রতিশ্রুতি সরকারের : প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধু-১ কার্যকর হলে বাংলাদেশের ৩০টি স্যাটেলাইট চ্যানেল বিদেশি স্যাটেলাইট ভাড়া নিতে বছরে যে বিশালসংখ্যক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এর প্রয়োজন হবে না বলে জানিয়েছিলেন সরকারের কর্মকর্তারা। আশা করা হচ্ছিল তখন দেশের টাকা আর বিদেশে যাবে না। কিন্তু কারিগরি দিক থেকে এই স্যাটেলাইটের অবস্থান ও ফ্রিকোয়েন্সির মাত্রা বিবেচনা করে বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর পক্ষে এটি ব্যবহার সম্ভব নয়। তবে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেছেন, দেশি চ্যানেলগুলো যেন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ব্যবহার করতে পারে এ জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন সম্ভব। এটা করতে সরকার প্রস্তুত। নতুন প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে তা করাও হবে। টিভি মালিকদের একজন বলেছেন, বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টিভিগুলোর জন্য সংশোধনী আনতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর