বুধবার, ২৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

জেগে থাকার পণ করেছে মন

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

জেগে থাকার পণ করেছে মন

সূর্য অস্ত যেতেই মুমিনের দস্তরখানা সেজে ওঠে বাহারি ইফতারে। মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে মধুর আজানের ধ্বনি। আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার। একটি খেজুর  বা এক গ্লাস পানি দিয়ে শুরু হয় ইফতার। ইফতার শেষে সালাতুল মাগরিব। কিছুক্ষণ বিশ্রাম। আবার শুরু হয়ে যায় সালাতুত তারাবি। তারাবি শেষে বাসায় ফিরেই শোয়ার প্রস্তুতি। সাহরিতে উঠতে হবে অল্প পরেই। এভাবেই কাটে মুমিনের মাহে রমজানের দিনগুলো। আমরা ঘুমাই। জেগে উঠি। আবার ঘুমাই। আবার জাগি। জীবনের এতটা বসন্ত এভাবেই পাড়ি দিয়েছি আমি-আপনি। হে আমার দরদি পাঠক! আমরা রমজানে জাগছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের ঘুমিয়ে থাকা আত্মাকে কি জাগাতে পারছি? সেই কবে কোন পাপের কাঠির ছোঁয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে আমাদের নফস। হায়! তাকে আর জাগিয়ে তোলা হয়নি। ঘুমের ঘোরেই সে চলছে গাফেলের মতো। চালাচ্ছে আমাদেরও। অথচ মুমিনের নফস তো এক মুহূর্তের জন্য ঘুমানোর কথা নয়। হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা, যারা আল্লাহকে ভালোবাসেন, তাদের চোখ ঘুমালেও অন্তর ঘুমায় না।’ একবার দুজন সাহাবি এসেছেন রসুল (সা.) কাছে। কী বিষয়ে যেন পরামর্শ করবেন। এসে দেখেন নবীজি (সা.) ঘুমিয়ে আছেন। তখন একজন আরেকজনকে বলল, চলো ফিরে যাই। নবীজি জেগে উঠলে আবার আসব। তারা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। তখন নবীজি ওঠে বললেন, হে আমার প্রিয় সাহাবি! আমি ঘুমাই ঠিকই; কিন্তু আমার মন ঘুমায় না। বল কী  জন্য এসেছিলে?’ যারা সুফি, আল্লাহর অলি, তারাও নবীজির দেখাদেখি নিজের আত্মাকে জাগানোর সাধনা করেছেন। কারণ আত্মা জাগ্রত মানুষই দুনিয়া-আখেরাতে খোদাতায়ালার প্রিয় বান্দা হতে পারেন। তারাই পারেন অন্যের ঘুমিয়েপড়া আত্মাকে জাগাতে। আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আব্বার কথা। তিনি এক পীর হুজুরের মুরিদ ছিলেন। শুনেছি যখন ওনার কাছে ভক্তরা আসতেন, তিনি ঘুমিয়ে থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়তেন। আর বলতেন, আল্লাহর অলিদের চোখ ঘুমায় কিন্তু মন ঘুমায় না। আল্লাহর অলিদের চোখ ঘুমায়, মন ঘুমায় না। আর আমাদের চোখ জেগে থাকে কিন্তু মন ঘুমিয়ে থাকে জীবনভর। মনকে জাগানো যায় জীবনভর সিয়াম সাধনা করে। আমাদের আর তাদের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। তো পাঠক! ইমাম গাজালি (রহ.) মারেফাতের ছাত্রদের নসিহত করতে গিয়ে বলেন, হে আরেফ! মারেফাত পথের যাত্রী, তুমি যখন ঘুম থেকে জাগো তখন খুব সতর্ক হয়েই জাগো। তোমার ঘুমিয়ে পড়া আত্মাকেও জাগিয়ে তোল। নিজেকে বল, যদি আজ এ সময়ে আমি আমার ঘুমন্ত আত্মাকে জাগাতে না পারি, তাহলে দুই চোখ বোজার পর কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন জীবন। মনকে বল, আল্লাহ চেয়েছেন, তাই আমি আজ জাগতে পেরেছি। এমন একদিন আসবে, ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু তিনি আর জাগতে দেবেন না। তখন তোমার কী হবে হে আমার আত্মা। হে পাঠক! রমজান এসেছে আত্মার দীনতা ধুয়ে-মুছে ফেলতে। ঘুমিয়েপড়া নফসকে জাগিয়ে তুলতে। গাফেলকে সতর্ক করতে। তো আপনি যখন সাহরির জন্য জাগেন, তখন খুব আবেগ নিয়ে, প্রেম নিয়ে আপনার ভেতরে থাকা নফসকে নসিহত করুন। দুই-চার মিনিট তার সঙ্গে একান্তে নিরিবিলি আলাপ করুন। নফস আপনার শত্রু। তাকে বন্ধু বানানোর চেষ্টা করুন। দেখবেন সে আর আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে ফিরিয়ে রাখবে না। রসুল (সা.) ও এ কাজটিই করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের সবার সঙ্গেই একটি শয়তানি শক্তি নফস দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই তোমাদের মনে খারাপ কাজের ইচ্ছা জাগে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনার ভেতরও কি সে শক্তি আছে? রসুল (সা.) বললেন, আমি আমার নফসকে মুসলমান বানিয়ে নিয়েছি। এখন সে আর আমার শত্রু নয়। সে আমার বন্ধু হয়ে গেছে। আসুন, আমরা আমাদের ঘুমিয়েপড়া আত্মাকে সিয়াম সাধনা করে জাগিয়ে তুলি। তাকে আমাদের বন্ধু বানিয়ে নেই। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের সাহায্য করুন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। চেয়ারম্যান : বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর