সোমবার, ৪ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

হাত বাড়ালেই ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে মাদক

সাখাওয়াত কাওসার

‘মাদকের অভয়াশ্রম জাবির আবাসিক হল—শিরোনামে নিউজ করলে ক্যাম্পাসের জাত গেল জাত গেল বলে যারা সাংবাদিকদের দায়ী করবেন, তারা আসুন, সালাম বরকত হলের ৪০১ নম্বর রুমের পাশের ওয়াশরুম থেকে একটু ঘুরে যান। প্রধানমন্ত্রী যখন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তখন এখানে কিছু ছাত্র ও বহিরাগত মদ, গাঁজা, হেরোইন দিয়ে সকালের নাশতা, দুপুরের খাবার, রমজানের ইফতার সঙ্গে সাহরিটাও সারতেছে। আর কত সহ্য করব ভাইয়ারা একটু বলবেন কি? প্রতিনিয়তই এখানে এসে মদ, গাঁজা, হেরোইন খাবে আর ওয়াশরুমগুলোতে বমি করে রাখবে। বমির দুর্গন্ধে আমার মতো কিছু শিক্ষার্থী আছে যাদের বমি করে অসুস্থ হতে হবে। হল প্রশাসনকে বিষয়টি কয়েকবার জানানোর পরও পরিত্রাণ মেলেনি। আর কত দিন এই মাদকসেবীদের সহ্য করবে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এখানে এসে যারা মাদক নেয় তারা অধিকাংশই বহিরাগত। তারা সালাম বরকত হল, এমনকি এই ক্যাম্পাসেরই না। এখানে চলছে মাদকের রমরমা বাণিজ্য। কারও প্রমাণ লাগলে আসুন একটু ঘুরে যান। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি, এবার একটু পরিত্রাণ চাই। আর বমি করে অসুস্থ হতে চাই না।’ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের এক ছাত্র ‘সুমন ৪১’ নামের ফেসবুক আইডি থেকে নেওয়া। এই স্ট্যাটাস ধরে পরবর্তী সময়ে অনুসন্ধানেও মিলেছে এর সত্যতা। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল নয়, দেশের প্রায় সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোর চিত্র অনেকটা একই রকম। রহস্যজনক কারণে নীরব হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযান কিংবা রেইডের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার জন্য বিশেষ বিধিনিষেধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এখনো মাদক বিক্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক মাদক ব্যবসায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে সেখানে অবস্থান করছে। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা মাদকের পৃৃষ্ঠপোষক ও ব্যবসায়ী হওয়ায় মাদক নির্মূলে চলমান সাঁড়াশি অভিযানেও তেমন একটা প্রভাব পড়েনি ক্যাম্পাসগুলোতে। অনেকটা আগের মতোই চলছে মাদক কেনাবেচা। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মাদকের বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানের সম্মানের কথা ভেবে অনেক সময়ই কর্তৃপক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তা নিতে চায় না। এতে করে প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার পরিবেশই নষ্ট হচ্ছে। সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে মাদক ব্যবসায়ীদের। নষ্ট হচ্ছে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যৎ। ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর পল্টনের নাইটিঙ্গেল মোড়ে পুলিশ ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নূরে মোজাচ্ছেম ওরফে রঙ্গনসহ তিনজনকে। মামলার এজাহারে বলা হয়, এই তিনজন দীর্ঘদিন ধরে পল্টনসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা বিক্রি করে আসছেন। তবে শুধু নূরে মোজাচ্ছেম নন, ঢাকায় বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক মাদক বেচাকেনায় জড়িত রয়েছেন একটি ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন শাখার নেতাদের অনেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের আবাসিক হলগুলোকে তারা ব্যবহার করছেন মাদক কেনাবেচার নিরাপদ স্থান হিসেবে। সম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থা দেশের ২২টি জেলার ৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪৭৮ জন মাদক ব্যবসায়ীর তালিকা করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ও আটটি কলেজ রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্র-শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মচারী, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতা এবং পুলিশ সদস্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায় বিশেষ করে সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও হাসপাতাল ক্যাম্পাসে (জরুরি বিভাগ ছাড়া) নিরিবিলি পরিবেশ থাকে। ওই সময় ইয়াবাসহ মাদক বেচাকেনা ও সেবন চলে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একশ্রেণির কর্মচারী ও শিক্ষার্থী ইয়াবা বেচাকেনা ও সেবনের সঙ্গে জড়িত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক কর্মকর্তা এর সত্যতা স্বীকারও করেছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. এ এফ এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘অপরাধী সে ছাত্রই হোক বা সন্তান, সে অপরাধীই। বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক মাদকের পৃষ্ঠপোষক, ব্যবসায়ী সে যে-ই হোক না কেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স।’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক শিকদার জুলকার নাইন বলেন, ‘আমরাও চাই বিশ্ববিদ্যালয় মাদকমুক্ত থাকুক। অতীতেও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের নির্দেশে তদন্ত কমিটি কাজ করেছে। এখন সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত। আমরাও চাই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো মাদকের সাপ্লাই চেইনটি যে কোনো মূল্যে বন্ধ করুক।’ জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কর্মচারী কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একাধিক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে মাদক ব্যবসা। সম্প্রতি একটি সংস্থার তৈরি করা প্রতিবেদনে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২ জনের মাদক ব্যবসায়ীর নাম উঠে এসেছে। তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক মিয়া মোহাম্মদ রুবেল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হক রাজীব, সহ-সাধারণ সম্পাদক তপনের নাম উঠে এসেছে। এ ব্যাপারে ওই ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মিয়া মোহাম্মদ রুবেলের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ ছাত্রনেতার ছত্রচ্ছায়ায় চলছে মাদক ব্যবসা। শিক্ষার্থীদের টার্গেট করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে মাদকের কারবার চলছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, চানখাঁরপুল মোড়, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বুয়েট, আনন্দবাজার, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, নীলক্ষেত, কাঁটাবন ও নিউমার্কেট এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা। ফুটপাথ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে চলছে মাদক সেবন। পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক কারবারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ১০ জন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১০ জনই এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। তারাও একটি ছাত্র সংগঠনের মদদপুষ্ট বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ক্যাম্পাসের অনেকেই তাকে মাদকসম্রাট বলে চেনে। এদিকে নিউমার্কেট থেকে ঢাকা কলেজ এলাকা পর্যন্ত বেশ কয়েকজন মাদক কারবার করে। তবে কলেজকেন্দ্রিক কারবারের নিয়ন্ত্রক পাঁচজন। ঢাকার হাজারীবাগের লেদার টেকনোলজি কলেজকেন্দ্রিক মাদক বাণিজ্য চালাচ্ছে সাতজন। ধানমন্ডির ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিকেন্দ্রিক মাদকের কারবার চালাচ্ছে ১৫ জন। সবচেয়ে বেশি মাদক কারবারি টাঙ্গাইলের মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে—৫০ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ও আশপাশ মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্য। তালিকায় তৃতীয় সর্বোচ্চ হিসেবে নাম আছে ময়মনসিংহের ত্রিশালের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২ জন। কিশোরগঞ্জের ঈশা খাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন, জামালপুরের সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজে ১৫ জন, মানিকগঞ্জের সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে ৩২ জন, মুন্সীগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজে ৮ জন, নারায়ণগঞ্জের রণদাপ্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ জন, গাজীপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৩০ জন, সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ জন, গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ জন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ জন, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ জন, প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে চারজন, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে চারজন, পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটিতে দুজন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চারজন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজে পাঁচজন, চাঁদপুর সরকারি কলেজে ১০ জন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে আটজন, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচজন, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৫ জন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ জন, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ জন, খুলনার নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ১৫ জন, যশোরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনজন, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ জন এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ জনের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে মাদকের বিষ ছড়ানোয় অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন।

সর্বশেষ খবর