মঙ্গলবার, ৫ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি

বিপাকে এলপিজি খাতের বিনিয়োগকারীরা

শামীম আহমেদ

আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় গ্যাস ও সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি এবং কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্কের কারণে হুমকিতে পড়েছে দেশের এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) খাত। সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ভোক্তাদের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ এ খাতে বিনিয়োগকারীদের। তাদের মতে, লাভ না দেখায় অনেক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পাওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিনে এ খাতে বিনিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না। আসছে না বিদেশি বিনিয়োগ। যারা ইতিমধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে ফেলেছে, তাদের অবস্থা নাজুক। দিনের পর দিন ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। না পারছেন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে, না পারছেন ভর্তুকি দিয়ে ব্যবসা চালু রাখতে। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের অপচয় রোধে ৭০ ভাগ আবাসিক জ্বালানির চাহিদা এলপিজি থেকে পূরণের যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে, তা বাস্তবায়নেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

এলপিজি আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারীরা বলছেন, দুই বছরে এলপিজি আমদানি খরচ কয়েক দফা বাড়লেও ক্রেতার সামর্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে কোম্পানিগুলো খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ায়নি, বরং কমিয়েছে। গত বছরের জুনে ১২ কেজি গ্যাস ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন করা হচ্ছে এক হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায়। অথচ গত বছর জুনে যেখানে প্রতি টন এলপিজি আমদানিতে (গ্যাসের মূল্য ও পরিবহন) খরচ হতো ৪৫৫ ডলার, এই জুনে তা বেড়ে ৬৮০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ডলারের দামও। প্রতি টন এলপিজি আমদানিতে খরচ বেড়েছে ২২৫ ডলার বা প্রায় ১৯ হাজার টাকা। তার ওপরে গত ছয় মাসে সিলিন্ডারের কাঁচামাল স্টিল আমদানি খরচ টন প্রতি ৩০০ ডলার থেকে বেড়ে ৬৮০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই খাতে শুল্ক মওকুপ সুবিধাও পায় না আমদানিকারকরা। এই অবস্থায় বর্তমান দামে গ্যাস বিক্রি করে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে ওমেরা এলপি গ্যাসের প্রধান নির্বাহী শামসুল হক আহমেদ বলেন, খরচ যেভাবে বাড়ছে, বিক্রয়ের দামের সঙ্গে সমন্বয় করা না গেলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হবে। এতে এলপিজি খাতটি শুরুতেই হুমকির মুখে পড়বে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিগত ৫-৬ বছরে এলপিজি খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি সহমত প্রকাশ করে সিলিন্ডারের ওপর কোম্পানিগুলো ভর্তুকি দিয়ে আসছে। আমদানিকৃত ১২ কেজির প্রতিটি সিলিন্ডারে ভর্তুকি দিতে হয় প্রায় এক হাজার টাকা। যারা দেশে আন্তর্জাতিক মানের সিলিন্ডার তৈরি করছে, কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বাড়ায় ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডারে উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৬০০-৮০০ টাকা। এর ওপরে রয়েছে কাঁচামালের আমদানি শুল্ক। এই অবস্থায় এলপিজি ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর স্বার্থে সিলিন্ডারের কাঁচামাল আমদানির ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, গ্যাস বিক্রি বাড়লে ধীরে ধীরে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে যাবে— এই আশায় কোম্পানিগুলো সিলিন্ডারে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়েও দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু সিলিন্ডার তৈরি ও গ্যাসের আমদানি খরচ বাড়ায় এলপিজি ব্যবসা এখন বিনিয়োগকারীদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে অনেকেই এ ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। যারা বিনিয়োগ করে ফেলেছেন বা বিনিয়োগের জন্য সবকিছু গুছিয়ে এনেছেন তারা চরম বিপাকে পড়েছেন। এ খাত বিদেশি বিনিয়োগের জন্যও বড় ধরনের হুমকি। লাফস গ্যাস বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী মোহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ১০-১২ বছর এই খাতে বিদেশি বিনিয়োগ নেই। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবে লাভের জন্য। কিন্তু বাজারে যদি কাঙ্ক্ষিত দামে পণ্য ক্রয়ের মতো ভোক্তা না থাকে তাহলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষ বিনিয়োগ করবে না। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত পাঁচ বছরে ৫৫টি প্রতিষ্ঠানকে এলপিজি আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে অনুমতি পেয়েও অনেক প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগে সাহস করছে না। গত জুনে এলপিজি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ছিল আটটি। এক বছরের মাথায় এখন তা বেড়ে ১২টিতে দাঁড়িয়েছে। আগামী বছরের শেষ নাগাদ এই সংখ্যা ২৫টিতে দাঁড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু কোম্পানিগুলো সিলিন্ডারে বড় অঙ্কের ভর্তুকি দেওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভোক্তা না বাড়ায় তখন বাজারে এলপিজির চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে ঝোকের মুখে ও না বুঝে যারা এ খাতে বিনিয়োগ করে ফেলেছেন তাদের অনেকেই বিপাকে পড়বেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ শেষের পথে। দ্রুত বিকল্প জ্বালানিতে যেতে না পারলে চরম বিপর্যয়ে পড়তে হবে। বর্তমানে প্রতি মাসে দেশে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন এলপিজি ব্যবহৃত হয় যা ২০২৫ সাল নাগাদ দুই লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগ হয়ে গেছে প্রায় পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। শিল্প ও অটোমোবাইলগুলোয় জ্বালানি হিসেবে এলপিজির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তবে এই বৃদ্ধির গতি খুবই মন্থর। খাতটিকে দ্রুত সম্প্রসারণে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রণোদনা প্রয়োজন। কারণ, এলপিজির ব্যবহার বাড়লে গ্যাসের অপচয় অনেকটাই কমে যাবে। এদিকে এলপিজির ব্যবহার বাড়িয়ে গ্যাসের অপচয় রোধে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে আবাসিক গ্যাসের নতুন সংযোগ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিভিন্ন সময়ে এলপিজি ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, বাসাবাড়ি ও পরিবহন খাতে ব্যবহার করা গ্যাসের ২০ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে। এলপিজি ব্যবহার বাড়লে এই ২০ শতাংশ গ্যাস সাশ্রয় হবে। তাই বর্তমান সরকার বাসাবাড়ি ও পরিবহন খাতে এলপিজিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। সরকারের এ সদিচ্ছার সঙ্গে একমত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এলপিজি ব্যবসায়। ভর্তুকি দিয়ে ঘরে ঘরে সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলো ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম না বাড়ালেও গত এক-দুই বছরে এলপিজি ও সিলিন্ডার উৎপাদন ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। অগ্রাধিকার খাত হিসেবে সিলিন্ডার তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক মওকুফের সুবিধাও পাচ্ছেন না। বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে এখন লাভ-লোকসানের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এভাবে চলতে থাকলে অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে। এলপিজি নিয়ে সরকারের লক্ষ্য শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে। কর্মসংস্থান হারাবে অনেক মানুষ।

সর্বশেষ খবর