শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

একাত্তরে নিক্সনের ভারত বিরোধিতার কারণ

প্রতিদিন ডেস্ক

একাত্তরে নিক্সনের ভারত বিরোধিতার কারণ

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ভূমিকার বিরোধিতায় যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন যেসব যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন, তা উঠে এসেছে অবমুক্ত করা কিছু গোপন নথিতে। ওই নথির বরাতে পিটিআইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিক্সন মনে করতেন, যুদ্ধে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ একটি ‘বাজে নজির’ স্থাপন করবে এবং ছোট দেশগুলোর ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে ফেলবে। সে সময় ক্যালিফোর্নিয়ার সান ক্লেমেন্টসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইসাকু সাতোর সঙ্গে এক বৈঠকে নিজের অবস্থান এভাবেই তুলে ধরেন নিক্সন। খবর বিডি নিউজ

যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭তম প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। নিজের দেশের আইন লঙ্ঘন হবে জেনেও সাড়ে চার দশক আগে তিনি যে মুক্তিকামী বাঙালিদের দমনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমরাস্ত্র যুগিয়েছিলেন, তা পাঁচ বছর আগে প্রকাশিত ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড’ বইয়ে উঠে আসে। পিটিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে নিক্সন একাত্তরে দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেন ‘সামরিক শাসনে থাকা ছয় কোটি মানুষের ছোট দেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি মানুষের বড় দেশ ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারের সামরিক পদক্ষেপ’ হিসেবে।  নথির রেকর্ড অনুযায়ী, নিক্সন সেদিন বলেন, ‘ভারত যত বড় আর যত গণতান্ত্রিক দেশই হোক না কেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন নিয়ে সে যদি প্রতিবেশী কোনো দেশে আগ্রাসন চালায় তাতে বিশ্বের সব ছোট দেশের ভবিষ্যতই হুমকির মুখে পড়বে।’  অন্যদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকে মনে করিয়ে  দেন যে, ভিয়েতনাম, কোরিয়া এবং পাকিস্তান-ভারতের ক্ষেত্রে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকায় সব সময়ই ভিন্নতা ছিল। নিক্সনের আশঙ্কা ছিল, একাত্তরের মার্চে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গনে সরাসরি যোগ দেওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাপান সরকার আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতার অংশ হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশিদের জন্য জরুরি সহায়তা পাঠাতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু নিক্সন বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আরও সময় নেওয়া উচিত। ওই বৈঠকে নিক্সন বলেন, শরণার্থীদের জরুরি সহায়তার বিষয়ে তার প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি ‘ইতিবাচক’ হলেও ওই সহায়তা যুদ্ধের খরচ জোগাতে ব্যবহূত হওয়ার আশঙ্কায় তাতে আপত্তি জানিয়েছে কংগ্রেস। তাকে উদ্ধৃত করে নথিতে বলা হয়, বাংলাদেশে যেহেতু ‘নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার মতো স্থায়ী’ একটি সরকার তখনো চালু হয়নি,  সেহেতু তখনই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হতো ‘অপরিপক্ব’ একটি সিদ্ধান্ত। পরিস্থিতি স্পষ্ট হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না।  

নিক্সন বলেন, ভারত যেহেতু কমিউনিস্ট রাষ্ট্র নয়, সেহেতু ভারতীয় সরকারের সঙ্গে মতাদর্শগত কোনো বিরোধ যুক্তরাষ্ট্রের নেই। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে কারণ এর ফলে একটি ‘বাজে নজির’ সৃষ্টি হচ্ছে। 

‘এ কারণেই আমরা জাতিসংঘে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিরোধিতা করেছি। তাছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা নারীরা বিপজ্জনক। ভারত ও ইসরায়েল দুই দেশই নারীর নেতৃত্বে যুদ্ধে নেমেছে।’ নথিতে বলা হয়, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওই বৈঠকে নিক্সন একটি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ নিয়েও কথা বলেন। সেখানে শরণার্থীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ত্রাণ সহায়তা এবং ইয়াহিয়া খানকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানোর কথা ছিল। কিন্তু ভারত সে সময় ‘নিজেদের স্বার্থকেই’ গুরুত্ব দেয়। নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার সে সময় ভারতের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেন। যেখানে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সালের পর থেকে (১৯৭১ পর্যন্ত) ভারতকে ২ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। আর ভারত ওই সময় রাশিয়া থেকে ৮০০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে এবং আরও ১৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজেরা অস্ত্র বানিয়েছে। এ বিষয়ে তিনি উপসংহার টানেন এভাবে ‘এর মধ্য দিয়ে কার্যত আমরা ভারতের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য অর্থ জোগাচ্ছি। আর একই সময়ে পাকিস্তানকে আমরা দিয়েছি ৫০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা, যার সঙ্গে আরও ১০০ ডলার তারা পেয়েছে সামরিক সহায়তা হিসেবে। পাকিস্তানের তুলনায় ১০:১ অনুপাতে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে ভারত দারুণ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।’ এই যুক্তি দেখিয়ে নিক্সন ওই বৈঠকে বলেন, ‘পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছে— এই অভিযোগ যে হাস্যকর, তা এতেই প্রমাণ হয়। আসলে সোভিয়েত সহায়তা নিয়ে ভারতই পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছে।’ হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত বিভিন্ন অডিও টেপের ভিত্তিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিক্সন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা নিয়ে ২০১৩ সালে একটি বই প্রকাশ করেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক গ্যারি ব্যাস। ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড’ নামের ওই বইয়ে তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার নানা দিক তুলে ধরেন। গ্যারি ব্যাস সেখানে লেখেন, নিক্সন ও কিসিঞ্জার সে সময় ভারত ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে অবৈধভাবে অস্ত্র সরবরাহ করেন।

সর্বশেষ খবর