শুক্রবার, ২২ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

এ কী করল আর্জেন্টিনা!

ক্রোয়েশিয়া ৩ : আর্জেন্টিনা ০

আসিফ ইকবাল

এ কী করল আর্জেন্টিনা!

জ্বলে উঠতে পারলেন না মেসি। হারল আর্জেন্টিনা। গতকাল ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ধরাশায়ীর পর —এএফপি

পারলেন না লিওনেল মেসি। পারল না আর্জেন্টিনা। হ্যাটট্রিকম্যান ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর গড়ে দেওয়া চাপ উতরাতে পারেননি মেসি। আর্জেন্টিনা পারেনি ‘বরফ রাজ্য’ আইসল্যান্ডের বিপক্ষে পয়েন্ট খোঁয়ানোর চাপ সামাল দিয়ে ম্যাচ জিততে। পূর্ব ইউরোপের দেশ ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। টানা দুই জয়ে ‘ডি’ গ্রুপ থেকে সবার আগে সেরা ১৬-তে জায়গা করে নিয়েছে ক্রোয়েশিয়া। হেরে গেলেও টানেলের শেষ প্রান্তে আলো দেখার মতো সম্ভাবনা রয়েছে আর্জেন্টিনার। এ জন্য সমীকরণের  মারপ্যাঁচের অপেক্ষায় থাকতে হবে মেসিদের। আইসল্যান্ডকে যদি নাইজেরিয়া হারিয়ে দেয়, তাহলে সম্ভাবনা থাকবে মেসিদের। তখন শেষ ম্যাচে নাইজেরিয়াকে হারাতে হবে মেসিদের। আর যদি আইসল্যান্ড জিতে যায়, তাহলে সম্ভাবনা ক্ষীণ হবে আর্জেন্টিনা। ১৯৮২ সালে প্রথম পর্ব ডিঙ্গাতে পারেননি আর্জেন্টিনা। সেবার নাইজেরিয়াকে ১-০ গোলে হারানোর পরের ম্যাচে হেরে যায় ইংল্যান্ডের কাছে। শেষ ম্যাচে সুইডেনের সঙ্গে ড্র করায় গ্রুপে তিন নম্বর দল হিসেবে শেষ করে বিশ্বকাপ। এর আগে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে প্রথম পর্ব ডিঙ্গাতে পারেনি আর্জেন্টিনা। এমন হারে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মেসি, ম্যারাডোনা। ভেঙে পড়ল আর্জেন্টিনা। বেদনায় বিমূক হলো বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীরা। হয় স্বর্গ অথবা নরক। দুইয়ের মাঝামাঝি নেই অনন্ত কোনো জায়গা। হয় সুখের চির সঙ্গী, কিংবা অনন্ত দুঃখের সঙ্গী! এখানেও নেই মাঝামাঝি কোনো অবস্থান। লিওনেল মেসি এমনই এক সমীকরণে দাঁড়িয়ে। একদিকে বিশ্বকাপ জিতে জাতীয় নায়ক হওয়ার প্রবল হাতছানি এবং ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনার সঙ্গে একাসনে বসার অন্তিম সুযোগ। বিপরীতে ব্যর্থতার ষোলোকলা পূরণ করে রয়েছে আজীবন আর্জেন্টাইনবাসীর চোখের দুশমন হয়ে থাকারও সম্ভাবনা। জাতীয় নায়ক কিংবা ভিলেন-এই দুয়ের সম্ভাবনায় মেসি এখন রাশিয়ায়। ফুটবল মহাযজ্ঞে স্বপ্নের ফুল ফোটাতে সবুজ গালিচায় খেলছেন। ‘বরফ রাজ্য’ আইসল্যান্ডের সঙ্গে পেনাল্টি মিস করে খলনায়কের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মেসি খেলতে নামেন ফিফা র্যাংকিংয়ের ২০ নম্বর দল ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত হেরে স্বর্গ থেকেই পতনের পথে মেসির! ক্লাব ফুটবলে সফল, আর্জেন্টিনার জার্সিতে ব্যর্থ- মেসি এমন তকমা বয়ে বেড়াচ্ছেন ২০০৬ থেকে। ২০০৬ ও ২০১০ সালে আলবিসেলেস্তারা বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। ২০১৪ সালে হেরে যায় ফাইনালে। তিনবারই বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনাকে বিদায় করেছে জার্মানি। তিনবারই বিদায় নিয়েছেন মেসি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে এবং ফিরেছেন নতুন করে স্বপ্নকে সঙ্গী করে। ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালের পর বিশ্বকাপের তৃতীয় শিরোপা উপহার দিতে পাঁচবারের বিশ্বসেরা ফুটবলার এবার এসেছেন লেনিনের দেশে। প্রথম ম্যাচে আইসল্যান্ডের রক্ষণাত্মক কৌশল ও গতির সঙ্গে পেড়ে উঠেননি। তার ওপর ইউরোপিয়ান লিগে টানা খেলার ক্লান্তিতে মেলেও ধরতে পারেননি নিজেকে। আলো ছড়াতে পারেননি বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার। প্রথম ম্যাচে জিততে না পারায় গতকাল আকাশসম চাপ নিয়ে খেলতে নামে আর্জেন্টিনা। ‘মাস্ট উইন’ ম্যাচে একাধিক পরিবর্তন এনে খেলতে নামেন মেসিরা। ক্রোয়েশিয়া নামে নাইজেরিয়াকে ২-০ গোলে হারানোর আত্মবিশ্বাস নিয়ে। জিতলেই ‘ডি’ গ্রুপ থেকে সবার আগে শেষ ১৬-তে জায়গা নেবে ক্রোটারা। এমন সমীকরণে মদ্রিক, মানজুকিক, রেবিচরা রক্ষণভাগকে শক্তিশালী করে দ্রুতগতির ফুটবল খেলতে থাকেন। অন্যদিকে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা মেসি ও আগুইয়েরেকোকে সামনে রেখে চেষ্টা চালায় দুরন্ত গতির ফুটবল খেলতে। প্রথমার্ধের খেলা শেষে ম্যাচে আধিপত্য ছিল আলবিসেলেস্তাদের। ৫৬ শতাংশ বল পায়ে রেখে দুবার গোলের সুযোগ সৃষ্টি করে। একবার ডান প্রান্ত থেকে উড়ে আসা বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি মেসি। ফলে এগিয়ে যাওয়া হয়নি। এরপর ২৬ মিনিটে সহজ সুযোগ নষ্ট করেন মেঝা। ডি বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে ক্রস করেন আগুইয়েরো। মেসি বল পায়ে ছোঁয়ানোর আগেই ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণভাগের একজন ক্লিয়ার করেন। বল ফাঁকায় পরে এবং সেখান থেকে মেঝা ঠিকমতো শট নিতে ব্যর্থ হন। ফলে গোল পায়নি সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। ৩৩ মিনিটে সহজ সুযোগ নষ্ট করেন বায়ার্ন মিউনিখের তারকা স্ট্রাইকার মানজুকিক। বাঁ প্রান্ত থেকে উড়ে আসা বলে হেড করতে ব্যর্থ হন মানজুকিক। অথচ  আর্জেন্টিনার গোলবারে তখন একা দাঁড়িয়ে গোলরক্ষক কাবালেরো। প্রথমার্ধের অতিরিক্ত সময়ে ফের সুযোগ নষ্ট করে ক্রোয়েশিয়া। এবারও হেড করতে পারেননি রেবিক। ফলে গোলশূন্য শেষ হয় প্রথমার্ধ। 

দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলই চাঙ্গা হয়ে খেলতে নামে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুর পর ৫৩ মিনিটে গোল খেয়ে বসে আর্জেন্টিনা। মাঝ মাঠ থেকে উড়ে আসা বল ধরে ব্যাক পাস করেন ডিফেন্ডার মারকাদো। কিন্তু ক্লিয়ার করতে পারেননি গোলরক্ষক কাবালেরো। বল পেয়ে যান ফাঁকায় দাঁড়ানো রেবিচ। কোনো ভুল না করে ভলিতে গোল করে উচ্ছ্বাসে মাতান ক্রোট সমর্থকদের (১-০)। ক্রোয়েশিয়ার জার্সিতে এটা রেবিচের দ্বিতীয় গোল। পিছিয়ে পরার পর ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পরে আর্জেন্টিনা। আক্রমণভাগকে আরও গতিশীল করতে কোচ সাম্পাওলি মাঠে নামা গঞ্জালো হিগুইন ও পাওলো দিবালাকে। মেসি, দিবালা ও হিগুইনের নেতৃত্বে আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগ আক্রমণের পর আক্রমণ শানাতে থাকে ক্রোটদের সীমান্তে। ৮০ মিনিটে খেলার বিপরীতে দ্বিতীয় গোল করে আর্জেন্টিনার কফিনে শেষ পেড়েকটি ঠুকে দেন মদ্রিক (২-০)। কাউন্টার অ্যাটাকে বল পেয়ে প্রায় ৩০ মিটার দূর থেকে দূরন্ত গতির শট খেলে আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক কাবালোরোকে বোকা বানিয়ে গোলসংখ্যা দ্বিগুণ করেন মদ্রিক (২-০)। ওই গোলের পর পরপরই নিশ্চিত হয়ে যায় সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের হার। ম্যাচে মেসিদের কফিনে শেষ পেড়েকটি ঠুকে দেন ৯১ মিনিটে ইভান রাতিকিচ (৩-০)। ৩-০ গোলে হেরে কার্যত বিশ্বকাপই শেষ হয়ে গেল আর্জেন্টিনা। একই সঙ্গে বিশ্বকাপ ট্রফি অস্পৃশ্যই রয়ে গেল লিওনেল মেসির!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর