বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

সিলেটে কেন এই বিপর্যয়

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সিলেটে কেন এই বিপর্যয়

রাজশাহী ও বরিশালে বিপুল ভোটে নৌকার প্রার্থীরা বিজয়ী হলেও সিলেটে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী সাবেক মেয়র ও পৌর চেয়ারম্যান বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের ফলাফল বিপর্যয় হওয়ায় কারণ বিশ্লেষণ চলছে দলের সব মহলে। সবখানে এক আলোচনা বিএনপির নেতা-কর্মীদের যেখানে গ্রেফতার আতঙ্ক তাড়া করছিল, ভোট কেন্দ্রে অনেক অনিয়ম ঘটেছিল, জামায়াতে ইসলামী আলাদা ভোট করেছিল, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল তবুও কেন ফলাফল বিপর্যয়, কেন পরাজয়ের মুখে পড়লেন কামরান? নির্বাচন শেষ হতে না হতেই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করা বিএনপি প্রার্থী সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী গলায় বিজয়ের মালা?

মূলত সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে টানা দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র পদে আরিফের জয় প্রায় নিশ্চিত। এখন আনুষ্ঠানিকতাটুকুই শুধু বাকি। নানামুখী চাপ সামলে, ভোটের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পরও সিলেটে আরিফের জয় এসেছে চমক             হিসেবে। গেল মেয়াদের উন্নয়ন কাজ আর ভোটের মাঠে আত্মবিশ্বাস নিয়ে টিকে থাকাই আরিফকে জয়ী হতে সাহায্য করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিপরীতে সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও কামরানের পরাজয়ে হতাশ আওয়ামী লীগ। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন দলের কিছু নেতার সন্দেহমূলক ভূমিকা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আর দলের কতিপয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিশ্বাসঘাতকতা কামরানকে পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

আরিফের জয়ের নেপথ্যে : সিলেট সিটি নির্বাচনে গেল সোমবার ভোট গ্রহণের দিন নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট প্রদান, এজেন্টদের মারধর ও কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে দেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী। ভোট গ্রহণ শেষে সংবাদ সম্মেলনেও এসব অভিযোগের বিবরণ দিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন তিনি। এবার নির্বাচনে ২০-দলীয় জোটের সঙ্গী জামায়াতও মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছিল। বিএনপির অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জামায়াত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এর আগে মনোনয়ন নিয়ে দলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন আরিফ। তাকে চ্যালেঞ্জ করে মেয়র পদে বিদ্রোহী প্রার্থী হন মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম। অবশ্য শেষ পর্যন্ত আরিফকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়ান তিনি। দল ও জোটের চ্যালেঞ্জ, নির্বাচনে অনিয়ম এসব কিছুর পর মেয়র পদে আরিফের জয়কে চমক বলার লোক অসংখ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিসিকের গেল নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হওয়ার পর আরিফুল হক চৌধুরী কয়েকটি মামলায় প্রায় তিন বছর কারান্তরীণ ছিলেন। কিন্তু বাকি সময়ে অর্থমন্ত্রীর বরাদ্দে তিনি নগরীর উন্নয়নে যে পরিশ্রম করেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসন, ছড়া-খাল উদ্ধার, সড়ক সম্প্রসারণ, হকার উচ্ছেদ, পানি সংকট কমানোর উদ্যোগ প্রভৃতি কাজ তার বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে। সাধারণ নগরবাসী আরিফের এসব কাজকেই ভোট দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সিসিকের এবারের নির্বাচনে আত্মবিশ্বাসের কমতি ছিল না আরিফের। জয়ের ব্যাপারে শেষমুহূর্ত পর্যন্ত আশাবাদী ছিলেন তিনি। ভোটে অনিয়ম, দখল উৎসব হলেও মাঠ ছাড়েননি আরিফ। তিনি শেষ দেখার পণ করেছিলেন। এ বিষয়টি নির্বাচনের মাঠে তাকে এগিয়ে নেয়। এ ছাড়া ভোটের দিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টার মধ্যেই নানা অনিয়ম হয়েছে। এসব অনিয়ম দেখে পরবর্তীতে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন। ভোটের আগে দলে যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন আরিফ, তাও নিজের ক্যারিশমেটিক গুণ কাজে লাগিয়ে সমাধান করে ফেলেন তিনি। ফলে দলের সবাই তার পক্ষে একতাবদ্ধ হয়ে মাঠে নামেন। বিএনপি নেতাদের মতে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়ার বিষয়টিও আওয়ামী লীগের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। মামলার কারণে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি গেছে আরিফের পক্ষে। এ বিষয়ে সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আরিফুল হক চৌধুরী সিলেটে দারুণ জনপ্রিয়। নগরীর উন্নয়নে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। ফজরের নামাজ পড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত নগরীর উন্নয়নে সময় ব্যয় করেছেন আরিফ। প্রভূত উন্নয়নও করেছেন। তার কর্মোদ্যম, উন্নয়ন, জনপ্রিয়তা এসবকিছুই তাকে বিজয়ী করতে সাহায্য করেছে।’ নির্বাচনে জয় প্রায় নিশ্চিত হওয়ার পর নগরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এই পুণ্যভূমিতে যে অন্যায় করে পার পাওয়া যায় না, তা এই নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে। আমার এই বিজয় জনগণের বিজয়। আমার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জনগণ রুখে দাঁড়ানোয় সত্যের জয় হয়েছে। আমি সব নগরবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা কঠিন সময়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। তাদের কাছে আমি ঋণী। এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। তবে তাদের সেবক হিসেবে যেন প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি।’

কেন কামরানের পরাজয় : ১৯৭৩ সাল থেকে নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তিনবার কমিশনার, একবার পৌর চেয়ারম্যান, টানা দুবার মেয়র হওয়ার গৌরব তার। কামরানের তুলনায় নির্বাচনী রাজনীতির মাঠে আরিফ যোজন যোজন ব্যবধানে পিছিয়ে। তবু সেই আরিফের কাছেই টানা দুবার মেয়র পদে হার মানলেন কামরান। বিশেষ করে এবারের পরাজয় কামরানের জন্য হতাশার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিগত নির্বাচনে দলীয় কোন্দল কামরানের পরাজয় ত্বরান্বিত করেছিল। কিন্তু এবার দল প্রকাশ্যে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরও হেরেছেন তিনি। ক্ষমতাসীন দলের এই নেতার পরাজয়ের কারণকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তার পরাজয়ের নেপথ্যে দলীয় নেতাদের প্রতি সন্দেহ, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর আস্থা, দলের কতিপয় কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিশ্বাসঘাতকতা, শীর্ষ নেতাদের কেন্দ্রে নৌকার পরাজয় প্রভৃতি কারণগুলোকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশ্লেষকদের মতে, এবার নির্বাচনের আগেভাগেই সিলেট আওয়ামী লীগের নেতাদের ডেকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। সে নির্দেশের ফলে নির্বাচনের মাঠে নেতারা ছিলেন ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তারপরও বিগত নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে কামরান এবার দলের নেতাদের প্রতি সন্দেহ মনোভাব পোষণ করেন। এক নেতার কাছ থেকে গোপনে অপর নেতার গতিবিধি সম্পর্কে খবর নিতেন তিনি। এ বিষয়টি ক্রমেই জানাজানি হওয়ায় অনেক নেতাই কামরানের প্রচারণা থেকে নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখেন। যার প্রভাব পড়েছে নির্বাচনের ফলাফলে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, কামরান নিজে খুলনা ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে সিলেটেও সেরকম কিছু হওয়ার আশায় ছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন নৌকা প্রতীকের পক্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং হবে, তার বিজয় তাই সুনিশ্চিত। এর ফলে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ছিল কামরানের, যা শেষপর্যন্ত হিতে বিপরীত হয়েছে। এবারের নির্বাচনে সিলেট আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের কেন্দ্র ছাড়া বাকি শীর্ষ নেতাদের কেন্দ্রে পরাজয় ঘটেছে নৌকা প্রতীকের। খোদ নিজের কেন্দ্রেই হেরেছেন কামরান। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের কেন্দ্রে দুটি বুথে ধানের শীষ ১ হাজার ৪৫২ ভোট পেলে নৌকা পায় মাত্র ৬৫৩ ভোট, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লুত্ফুর রহমানের কেন্দ্রে নৌকা ২৬০ ভোট পেলেও ধানের শীষ পায় ৫০৯ ভোট, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেলের কেন্দ্রে ধানের শীষ ১ হাজার ৩০৮ ভোট পেলেও নৌকা পায় মাত্র ৫৬৬ ভোট। নির্বাচনে কামরান যাদেরকে এজেন্ট নিয়োগ করেছিলেন, তাদের সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করেননি। এজেন্টদের অনেকেই ছিলেন বিএনপি সমর্থক। এ ছাড়া ভোটের দিন নগরীর কাজী জালাল উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসহ কয়েকটি কেন্দ্রে বুকে নৌকা প্রতীকের কার্ড ঝুলিয়ে কেন্দ্র দখল করে ধানের শীষ প্রতীকে সিল মারার ঘটনাও ঘটেছে, যা কামরানের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করেছে। সামগ্রিক বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সারা দেশের মতো সিলেটেও বর্তমান সরকার উন্নয়ন কাজ করেছে। সিলেট নগরীর উন্নয়নে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত টাকা দিয়েছেন, কাজ করেছেন আরিফ। মানুষের কাছে অর্থমন্ত্রী নন, আরিফই দৃশ্যমান ছিলেন। তাই মানুষ মনে করেছে, আরিফকে ভোট দিলে ভালো হবে।’ সিসিকে কয়েকটি কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে ধানের শীষ প্রতীকে সিল মারা হয়েছে। নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে ঢুকে ধানের শীষে ভোট দেওয়া হয়েছে। একটি কেন্দ্রে আমার ওপর হামলার চেষ্টা হয়েছিল। ভোট জালিয়াতির মহৌৎসব করেছে বিএনপি। যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, সেগুলোর তালিকা নির্বাচন কমিশনে দিয়ে আমরা পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি জানিয়েছি। যেসব কেন্দ্রে গোলাগুলি হয়েছে, দখল করা হয়েছে, সেগুলোর ফলাফল আমরা মানি না। এসব কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণের দাবি আমাদের।’

কামরানের বাসায় আরিফ : বিজয় প্রায় নিশ্চিত হওয়ায় বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী গতকাল বিকালে আওয়ামী লীগ নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বাসায় ছুটে যান। কামরান হাসিমুখে বরণ করেন আরিফকে। এ সময় নগরীর উন্নয়নে সহযোগিতা চান আরিফ। সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন কামরান। উভয় নেতা বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করেন। আরিফের সঙ্গে তার স্ত্রী শ্যামা হকও ছিলেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর