বুধবার, ১ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

দ্রোহের অনলে রাজপথ

গাড়ি ভাঙচুর আগুন, সড়ক অবরোধ ছাত্রদের, শাজাহান খানের দুঃখ প্রকাশ, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্রোহের অনলে রাজপথ

দুই সহপাঠী হত্যার প্রতিবাদে গতকাল রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবরোধ —রোহেত রাজীব গ্রেফতার করা হয়েছে প্রধান অভিযুক্ত চালক মাসুম বিল্লাহসহ কয়েকজনকে (ডানে)

রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে তৃতীয় দিনের মতো অবস্থান ও অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় তিনটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন ও একাধিক গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কোথাও কোথাও পুলিশ শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এদিকে র‌্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতার তিন বাস চালকের কারও লাইসেন্স ছিল না। এ ছাড়া তিনটি বাসের মধ্যে দুটি বাসের কাগজপত্র ঠিক ছিল না। সড়ক পরিবহনে নৈরাজ্যের প্রতিবাদে দিনের শুরুতে ৯টি দাবি নিয়ে ফার্মগেট মোড়ে সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকে একের পর এক রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক অবরোধ করা হয়। সকালে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ শুরু করেন। এরপর ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, ধানমন্ডি, নাবিস্কো, উত্তরা, কাকরাইল, শাহবাগ, সাইন্সল্যাব, মতিঝিল মোড় অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। চরম ভোগান্তিতে পড়ে পথ চলতি মানুষ। সড়কগুলোতে যানবাহন স্থবির হয়ে থাকায় মানুষ পায়ে হেঁটেই নিজ নিজ গন্তব্যে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এর আগেও সড়কে গাড়ির বেপরোয়া চলাচলে নিহত হওয়ার ঘটনায় কোনো বিচার না হওয়ায় প্রতিনিয়তই একই ঘটনা ঘটছে। সকাল থেকে ফার্মগেটের সড়কে অবরোধ করেন সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থীরা। অবরোধ থেকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ, নিরাপদ সড়ক ও ঘাতক বাসের চালকের দ্রুত বিচার ও ফাঁসি দাবি ছাড়াও বেশ কয়েকটি দাবি করা হয়। ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচে শিক্ষার্থীদের অবস্থানের কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা রাস্তার দুই পাশে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তারা তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করে। বেলা একটা থেকে উত্তরার কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা উত্তরার জসীমউদ্দীন মোড় ও হাউস বিল্ডিং মোড় অবরোধ করেন। এ সময় পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে তাদের কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। অবরোধের ফলে উত্তরা-বিমানবন্দর সড়কের উভয়পাশে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় দুটি যাত্রীবাহী বাসে আগুনসহ একাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরে উত্তরা হাউস বিল্ডিং ও জসীমউদ্দীন রোডে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। রাস্তা অবরোধ করে তারা বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা একটি পিকআপসহ বেশ কয়েকটি বাসে ভাঙচুর চালায়। এতে পুলিশ-র‌্যাব বাধা দেয়। এতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে লাঠিচার্জ করলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বুশরা পরিবহন ও এনা পরিবহন বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়।  বেলা ১২টা থেকে নটর ডেম কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় তারা নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগ ও ঘাতক বাসচালকের ফাঁসির দাবিতে স্লোগান দিতে থাকে। রাস্তা অবরোধের কারণে শাপলা চত্বর এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা একটি বাস ভাঙচুর করেন। দুপুরে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী অবরোধের চেষ্টা করলে পুলিশ ধাওয়া দেয়। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তাক্ত হন মিরপুর শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের এক শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও গুরুতর আহত হয় আরও দুজন। আহতদের মিরপুর গ্যালাক্সি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বেলা সাড়ে ১১টায় মিরপুর-১, ২ ও ১১ নম্বর সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা কমার্স কলেজ ও বিসিআইসি কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখানে তারা বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের সরিয়ে দেয়। রামপুরা ব্রিজে নামে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। কাকরাইলে অবরোধে নামে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা পৌনে ১২টার দিকে সাইন্সল্যাব মোড়ে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন সিটি কলেজ এবং ধানমন্ডি আইডিয়ালসহ বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে মিরপুর রোড, নীলক্ষেত এবং শাহবাগ থেকে সাইন্সল্যাব এলাকার যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা হিমাচল পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। র‌্যাব সদর দফতরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার ৩ বাস চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের যে লাইসেন্স রয়েছে সেটা বাস চালানোর জন্য নয়। এ ছাড়া ৩টি গাড়ির মধ্যে দুটি গাড়ির কাগজও ঠিক নেই।

এদিকে, গতকাল রাতে বিমানবন্দর রেল স্টেশনের সামনে শতাধিক শিক্ষার্থী মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সবার হাতে ছিল প্লেকার্ড। শিক্ষার্থীরা বলেন, অবিলম্বে দোষী চালকদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এ ধরনের সাহস আর কেউ না দেখাতে পারে।

চালক-হেলপারের রিমান্ড শুনানি ৬ আগস্ট: বিমানবন্দর সড়কে দুই শিক্ষার্থীকে পিষে মারার ঘটনায় গ্রেফতার জাবালে নূর পরিবহনের চার কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে আসামিদের রিমান্ড শুনানির জন্য ৬ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম এইচ এম তোয়াহা এ আদেশ দেন। আসামিরা হলেন— দুই বাসের চালক সোহাগ আলী ও জুবায়ের এবং হেলপার এনায়েত হোসেন ও রিপন।

দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর : বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ঘটনাটি দুঃখজনক, আমরা মর্মাহত। প্রধানমন্ত্রীও দুঃখ পেয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। সে কারণে তিনি আমাকে পরিবারটির খোঁজখবর নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মর্মাহত। তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছেন। তাই এ বিষয়ে তিনি খুবই কঠোর। গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজ কক্ষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এর আগে তিনি মহাখালীতে বাসচাপায় নিহত দিয়া খানম মীমের বাসায় গিয়েছিলেন তার পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানাতে। এ ছাড়া সেটি আমার নির্বাচনী এলাকা। তাই সেখানে গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রীও আমাকে যেতে বলেছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা বা পাল্লাপাল্লি করা, যে কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটুক তা খুঁজে বের করা হবে। যে কারণে বা যার কারণে ঘটনা ঘটেছে তাদের শাস্তি পেতে হবে। এই নৈরাজ্যের প্রতিকার হওয়া উচিত। ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন।

বাসের প্রতিযোগিতা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, আমার স্বীকার করতে বাধা নেই এটি রাস্তায় হয়। ক্যান্সার ও কিডনি রোগে বছরে যত মানুষ মারা যায়, দুর্ঘটনায় তারচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। ঢাকা শহরের এই দুর্ঘটনা বন্ধ করতে সেইফ ঢাকা নামে একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। ঢাকা শহরের সড়ক ব্যবস্থাপনায় নতুন নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে যানজট ও সড়ক দুর্ঘটনা কমে যাবে। চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা আন্দোলন করে। এক্ষেত্রে এমন হলে কী করবেন— এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

হত্যার বিচার দাবিতে জাবিতে মানববন্ধন : বেপরোয়া গাড়ি চালকদের একের পর এক হত্যার প্রতিবাদ, দোষীদের শাস্তি দাবি এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে মানববন্ধন করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে ভাস্কর্যের পাদদেশে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবি জানিয়ে বলেন, হানিফ পরিবহনের বাস কর্মচারীদের দ্বারা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েল হত্যা এবং রবিবার ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় জড়িত বাস চালকদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

আমি মর্মাহত, বিব্রত : রবিবার বিমানবন্দর সড়কে বাসপাচায় দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যে মুচকি হাসি হেসেছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমি মর্মাহত, বিব্রত। গতকাল বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। শ্রমিক-কর্মজীবী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের অনুষ্ঠানটিতে মন্ত্রী বলেন, সেদিন আমি মোংলা বন্দর নিয়ে একটি চুক্তি সইয়ের অনুষ্ঠানে ছিলাম। সে সময় সাংবাদিকরা আমাকে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। কিন্তু, তখনো আমি সেই দুর্ঘটনার বিষয়টি জানতাম না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর