পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার প্রাচীন নিদর্শনের একটি স্থানের নাম আলীর সুড়ঙ্গ। রহস্যজনক এ সুড়ঙ্গ নিয়ে নানা কিংবদন্তি ও রূপকথা প্রচলিত আছে। স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘আলীর সুরঙ্গ’ বা ‘আলীর সুরম’ নামে অভিহিত করা হয়। উপজেলার সরকারি পরিসংখ্যান অফিস এ আলীর সুড়ঙ্গকে ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে দাবি করে নথিভুক্ত করেছে। আলীকদম উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকে একটি পাহাড় আছে, যাকে আলীর পাহাড় নামে অভিহিত করা হয়। এ পাহাড়েই রহস্যজনক ৩/৪টি সুড়ঙ্গের অবস্থান। এসব সুড়ঙ্গ নিয়ে নানা রূপকথা ও ভৌতিক কল্পকাহিনীর পাশাপাশি সত্য কাহিনীর নজিরও রয়েছে। কথিত আছে, প্রাচীন আলীকদমে সভ্যতার লোকালয় থেকে মাতামুহুরী নদী তীরবর্তী আলীর পাহাড়ে একদল মেহনতি কাঠুরিয়া জীবিকার সন্ধানে কাঠ, বাঁশ আহরণে যায়। প্রতিদিনের মতো পরিশ্রান্ত কাঠুরিয়ার দল নদীর ঢালুর পাড়ে নির্মিত এক চালা ঝুপড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। সে সময় একজন জটাধারী লোক হঠাৎ তাদের সামনে আভির্ভূত হলে কাঠুরিয়ারা ভীত-বিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কাঠুরিয়ারা লোকটির দিকে তেড়ে যান। তখন লোকটি হাত জোড় করে বলে ওঠেন, ‘আমাকে মের না। আমি কোনো জিন, ভূত, পাগল বা দস্যু নই। আমি এক বিপন্ন, হতভাগ্য লোক। আমাকে আশ্রয় দাও।’ লোকটির করুণ মিনতিতে কাঠুরিয়ারা তাকে আশ্রয় দেন। তখন লোকটি তাদের কাছে বলেন, অনেকদিন আগে আমরা তোমাদের মতো একদল কাঠুরিয়া আলীর সুড়ঙ্গ সংলগ্ন স্থানে বাঁশ কাটতে এসেছিলাম। একদিন সবাই গভীর অরণ্যে বাঁশ কাটতে যাই। এ সময় আমি সঙ্গীদের থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোত্থেকে আদিম এক রূপসী কন্যা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। তার পরনে ছিল গাছের পত্রপলব। আমার সঙ্গী সাথীরা অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমাকে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথে বাসায় ফিরে গেলেন। তারা মনে করলেন, আমি কোনো হিংস্র জীবজন্তুর শিকারে পরিণত হয়েছি। সঙ্গীদের খোঁজাখুঁজি আমি লক্ষ্য করলাম, কিন্তু আওয়াজ করার মতো শক্তি তখন আমার ছিল না। পরে ওই রূপসী কন্যা আমাকে নিয়ে আলীর সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ল!
লোকটি আরও বলেন, আলীর পাহাড়ে সুড়ঙ্গ রয়েছে পর পর তিনটি। আমাকে নিয়ে ওই রূপসী সুড়ঙ্গের তৃতীয়টিতে প্রবেশ করল। সে থেকে আমি নিস্তব্ধ অন্ধকারে বন্দী হলাম। আমার মনে হয় মহিলাটির উদ্দেশ্য ছিল আমাকে তার সঙ্গী করা। বাস্তবেও ঘটেছিল তাই। মাঝে মধ্যে ওই রূপসী শ্বেতকায়ার বিশাল দেহী ইয়া লম্বা মহিলায় রূপ নিত। তার অবয়ব হয়ে যেত অদ্ভুত আকৃতির। তার পরনে থাকত পশুর চামড়া। পাখির পলক ছাড়া কোনো অলঙ্কার ছিল না। আগুনের ব্যবহার জানত না। পশু পাখির মাংস ও ফলমূল খেয়ে জীবিকানির্বাহ করত। ক্ষুধার জ্বালায় আমিও আস্তে আস্তে সেসব খেতে বাধ্য হলাম। মহিলাটি আমাকে সুড়ঙ্গে রেখে গহিন অরণ্যে একাকি ঘুরে বেড়াত। শিকারে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে গুহার মুখে একটি বড় পাথর চাপা দিয়ে রাখত, যাতে আমি সুড়ঙ্গ থেকে কোনোমতে বের হতে না পারি। দিন যায়, মাস যায়— এভাবে বছর পার হয়। ক্রমান্বয়ে মহিলাটি আমার সঙ্গে ভাব জমাতে শুরু করে। সৌহার্দ্য সম্প্রীতি ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে আমরা একে অপরের কাছাকাছি আসতে থাকি। কখন দিন রাত হয় গুহার মধ্য থেকে আমি কিছুই জানতে পারতাম না। তিমির সুড়ঙ্গের বন্দী জীবন আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল। মহিলাটি তার মানস কামনা চরিতার্থ করতে আমাকে কাছে টানতে থাকে। আমিও তার ভয়ে সবকিছু করতে বাধ্য হতাম। এক পর্যায়ে আমাদের অভিসারের ফলে মহিলাটির গর্ভে সন্তান আসে। যথারীতি মহিলাটি একটি ফুটফুটে সন্তান প্রসব করে। ডাইনিটি তখন মনে করল আমি তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে গেছি। কিন্তু আদৌ তার প্রতি আমার আসক্তি ছিল না। আমরা একে অপরের ভাষা বুঝতাম না। ইশারা ইঙ্গিতে আমাদের কথাবার্তা হতো। একদিন ডাইনি শিকারে যাওয়ার সময় গুহামুখে পাথর চাপা দিয়ে যায়নি। এতে করে বাইরে থেকে সূর্যের আলোর ঝলকানি ছিদ্র পথে গুহার ভিতর প্রবেশ করে। তখন আমি এই সুযোগটি গ্রহণ করি এবং গুহা থেকে বেরিয়ে আসি। বাইরে এসে এই মায়াময় পৃথিবীর আকাশ, হৃদয় দোলানো বাতাস আমার অস্তিত্ব নতুনভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। প্রকৃতির কোলাহল মনকে দোলা দিতে থাকে। সুন্দর পৃথিবীর অতীত স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। ডাইনির কথা মনে পড়তেই আমি সেখান থেকে এইত পালিয়ে তোমাদের সামনে এলাম! তাদের সেই পারস্পরিক আলাপচারিতার শেষ হতে না হতেই হঠাৎ ডাইনি মহিলা তার শিশুকে বুকে জড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হয়। সবাই হতভম্ব ও দিকভ্রান্ত হলেন। তখন ডাইনি রক্তচক্ষে পালিয়ে আসা লোকটির দিকে তীক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তর্জন-গর্জন করতে থাকে। সেখানে দাঁড়িয়ে ডাইনি অনেক্ষণ অরণ্যরোদন করল। তার সেই কান্নায় বিরহের সুর ফুটে ওঠে। একপর্যায়ে তার আচরণে হিংস্রতা প্রকাশ পায়। তখন দুর্বোধ্য ভাষায় কোলের শিশুকে কী যেন বলতে চাইল। অতঃপর বাচ্চাটির দুপা ধরে টান দিয়ে আকস্মিক দ্বিখণ্ডিত করে ফেলল। এর এক খণ্ড তার প্রণয়ী লোকটির প্রতি নিক্ষেপ করল, অপর খণ্ড ডাইনি মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে গহিন অরণ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই হতে সভ্য জগতের কোনো লোকচক্ষুর সামনে ডাইনিটি দৃশ্যমান হয়নি।