মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

দুর্ঘটনা হত্যা প্রমাণে ফাঁসি

সড়ক আইনে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর জেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনায় সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রেখে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে সরকার। একই আইনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ সাজা হবে মৃত্যুদণ্ড। গতকাল সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে সম্পূরক এজেন্ডা হিসেবে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইনের এ খসড়ায় মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বলা হয়েছে, এ আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন মোটরযান চালনাজনিত কোনো দুর্ঘটনায় গুরুতরভাবে কোনো ব্যক্তি আহত বা প্রাণহানি ঘটলে এ-সংক্রান্ত অপরাধ পেনাল কোডের (দণ্ডবিধি) ৩০২, ৩০৪ ধারা অনুযায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। তবে দণ্ডবিধির কোন ধারায় মামলা হবে তা তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। তিনি বলেন, এটা অবস্থার গুরুত্ব অনুযায়ী এভিডেন্স বেইজড (প্রমাণসাপেক্ষে) হবে। যদি বোঝা যায় সে স্বেচ্ছায় কাজটা করেছে, ইচ্ছাকৃত কাউকে সে পিষে দিল এ রকম ঘটনা, এটা পেনাল কোড বা সংশ্লিষ্ট ধারায় এর শাস্তি হবে। তদন্তে নির্ধারণ হবে এটা কোন লাইনে যাবে, দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হবে, নাকি ৩০৪ ধারায়। শফিউল আলম বলেন, তবে শর্ত থাকে যে, পেনাল কোডে সংশ্লিষ্ট সেকশন ৩০৪ (বি)তে যা কিছু থাকুক না কেন ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালানোর ফলে সংঘটিত দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত হলে বা তার প্রাণহানি ঘটলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

শফিউল আলম বলনে, পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও যাত্রীদের সঙ্গে আলোচনার পর সব শ্রেণির সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতেই নতুন আইনে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছর করা হয়েছে। ব্রিফিংয়ে অংশ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালনার কারণে প্রাণহানির ক্ষেত্রে তদন্তে যদি প্রমাণিত হয় ইনটেনশন (ইচ্ছাকৃত) ছিল তবে এর শাস্তি ৩০২ ধারা অনুযায়ী হবে, এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তিনি জানান, পাশের দেশগুলোয় সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক নিরাপত্তার জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। এটা কিলিং পর্যায়ে গেলেই কেবল ৩০২-এ যাবে। নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি সর্বাচ্চ চার মাসের জেল বা ৫০০ টাকা অর্থদণ্ড। প্রস্তাবিত নতুন আইনে এই অপরাধে ছয় মাসের জেল ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড রাখা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে এই অপরাধের সাজা তিন মাসের জেল বা ২ হাজার টাকা জরিমানা। তিনি বলেন, বিদ্যমান আইনে ফিটনেসবিহীন গাড়ির জরিমানা সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল বা ২ হাজার টাকা জরিমানা। প্রস্তাবিত আইনে এই সাজার পরিমাণ ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সড়ক সচিব জানান, গাড়ির চেসিস পরিবর্তন, জোড়া দেওয়া, বডি পরিবর্তন করার শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড রয়েছে, সেটাকে বাড়িয়ে এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।

সড়কের ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা হলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী দায়ী হবেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, তাদের দায়ী করা হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা বা ত্রুটিপূর্ণভাবে পালনের জন্য দুর্ঘটনা ঘটলে ওই কর্মচারীকে দায়ী করে প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। শফিউল আলম বলেন, চুক্তি করতে হলে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগবে, আর শ্রম আইন অনুযায়ী মালিক ও চালককে চুক্তিপত্র করতে হবে। তিনি জানান, নতুন আইন পাস হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে অপেশাদারদের জন্য বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। আর পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ২১ বছর। অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদ না থাকলে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন না। আইনে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে বিদেশের পয়েন্ট সিস্টেম সংযোজন করা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, প্রত্যেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট করে বরাদ্দ থাকবে। অপরাধ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে, পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। ড্রাইভিং লাইসেন্সধারী ব্যক্তি অপ্রকৃতিস্থ, অসুস্থ, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম, মদ্যপ বা অপরাধী হলে সরকার তার ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইনে সরকারি, লাশ বহনকারী ও সৎকারে নিয়োজিত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স এবং রেকারগুলোকে রুট পারমিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, নতুন আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে সমগ্র বাংলাদেশ বা যে কোনো এলাকার জন্য যে কোনো ধরনের মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে পারবে। আর যে কোনো ধরনের গাড়ির জীবৎকাল (আয়ুষ্কাল) সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে নির্ধারণ করে দিতে পারবে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, প্রস্তাবিত আইনে চালক ও তার সহকারীদের যথাযথভাবে রেস্টের (বিশ্রাম) জন্য, তাদের সুবিধার জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে। নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আবশ্যিকভাবে সেই কর্মঘণ্টা বা বিরতিকাল মেনে চলতে হবে। এ ছাড়া মোটরযানের গতিসীমা, শব্দমাত্রা এবং পার্কিংয়ের বিষয়ে আইনে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, মদ বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালকের সহকারী গাড়িতে অবস্থান করতে পারবে না। চালকের সহকারীদের যানবাহন চালানোর দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। সড়ক বা মহাসড়কে উল্টো পথে গাড়ি চালাতে পারবে না। মোটরযান চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন বা অনুরূপ কোনো কিছু ব্যবহার করতে পারবে না। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, প্রস্তাবিত আইনে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কোনো মোটরযান দুর্ঘটনায় কেউ আঘাতপ্রাপ্ত বা মারা গেলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা তার উত্তরাধিকারী আর্থিক সহায়তা তহবিল থেকে ট্রাস্টি বোর্ড কর্তৃক ক্ষতিপূরণ বা চিকিৎসার খরচ পাবেন। এ সহায়তা তহবিল কীভাবে গঠন হবে আইনে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। ওই তহবিল পরিচালনায় ট্রাস্টি বোর্ড করা হবে। সরকারি অনুদানের পাশাপাশি মোটরযানের মালিকের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদা, এ আইনের অধীন জরিমানার অর্থ, মালিক সমিতির অনুদান, মোটরশ্রমিক ফেডারেশন বা সংগঠনের অনুদান বা অন্য যে কোনো বৈধ উৎস থেকে পাওয়া অর্থ নিয়ে এ তহবিল গঠন করা হবে। এ ছাড়া সিটবেল্ট বাঁধা, যান চলাচলে যাত্রীরা যাতে চালককে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করেন, মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে যাতে অন্য কেউ না বসতে পারে এসব বিষয়ে নির্ধারিত বিধান অনুসরণে নির্দেশনা রয়েছে প্রস্তাবিত আইনে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট চালক ও তার সহকারীরা তাত্ক্ষণিকভাবে নিকটস্থ থানা এবং ক্ষেত্রমতে ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসাসেবা ও হাসপাতালকে অবহিত করবে। আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তির জীবন রক্ষার্থে নিকটস্থ সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতালে পাঠানো ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। পুলিশ দেশব্যাপী টোল ফ্রি নম্বর প্রবর্তন করবে (জরুরি নম্বর ৯৯৯)। যার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত মোটরযানের চালক ও তার সহকারী, মালিক, পরিচালক বা তাদের প্রতিনিধি বা অন্য কোনো ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন করে জানাতে পারবেন। প্রসঙ্গত, রাজধানীর রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম ও দিয়া খানম মিম ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় গাড়িচাপায় নিহত হওয়ার পর দায়ী চালকের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। এর পরপরই সরকার আইনটি দ্রুত মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়।

সর্বশেষ খবর