বৃহস্পতিবার, ৯ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

মায়ের মতো সাথী ছিলেন বলেই বাবা সফল : শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

মায়ের মতো সাথী ছিলেন বলেই বাবা সফল : শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের অবদানের কথা স্মরণ করে তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মা’র সময়োচিত সিদ্ধান্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। যে কোনো ক্রাইসিসে আমার মা’র সিদ্ধান্ত দেওয়ার অতুলনীয় ক্ষমতা ছিল। আব্বা মায়ের মতো একটা সাথী পেয়েছিলেন বলেই সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন।

গতকাল সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেগম ফজিলাতুন নেছা ইন্দিরা এমপি। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মোমেন, জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক মমতাজ বেগম, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার জীবন ও কর্মের ওপর একটি ভিডিও প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীতে যা কিছু অর্জন হয়, তার পেছনে প্রেরণা দেওয়ার কেউ না কেউ থাকেন। তা না হলে কখনো কোনো নেতাই সফলকাম হন না। ঠিক তেমনি আমার বাবার রাজনীতির পেছনে আমার মায়ের বিশাল অবদান রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে আমার মা দৃঢ়চেতা ছিলেন। তিনি বলেন, মার্শাল ল দেওয়ার পর নেতা-কর্মীরা জেলে। পরিবারগুলো বাজার করতে পারে না। আমার মা কিন্তু নিজের কথা চিন্তা করেননি। আওয়ামী লীগের কোন নেতা, কার বাড়িতে চুলা জ্বলল কি না, তার খবরটা রাখতেন, কোনো কর্মী অসুস্থ কি না তার খবরটা রাখতেন। নিজের ঘরে খাবার আছে কি না, সেটা তিনি কখনো দেখতেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী কোন অবস্থায় আছে, গরিব আত্মীয়-স্বজনকে দেখা, তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদি থেকে শুরু করে লেখাপড়া, চিকিৎসা, সবকিছু যেন আমার বাসা ছিল অবারিত দ্বার। সবার জন্যই যতটুকু পারতেন সাহায্য করে যেতেন। শেখ হাসিনা বলেন, আন্দোলন কীভাবে করতে হবে, সেটা আমার মায়ের কাছ থেকেই শেখা দেখা।

বঙ্গমাতা ছিলেন ‘গেরিলা’ : বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকা অবস্থায় তার নির্দেশনা কীভাবে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দিতেন, সেটিও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িকে ঘিরে তখনকার গোয়েন্দা সংস্থা আইবির নজরদারি থাকত। তারা সব সময় পাহারায় রাখত বাড়ির লোকজন কোথায় যায় না যায়। আমার মা তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ছোট ফুপুর বাসায় যেতেন আমাদের নিয়ে। ছোট ফুপুর বাসায় কিছু বিহারি থাকত তারা বোরকা পরে চলত। (তাদের মতো) চকচকে পাথরওয়ালা স্যান্ডেল, তারপর শাড়ি নিয়ে মা ফুপুর বাসায় কাপড় চেঞ্জ করে বোরকা পরে স্কুটার নিয়ে চলে যেতেন আজিমপুর। সেখানে ছাত্র নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করতেন, আব্বা কারাগারে থেকে যে নির্দেশনাগুলো দিতেন বা স্লোগানগুলো দিতেন, সেগুলো পৌঁছে দিতেন। এই খবরগুলো কোনো দিন ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা পায়নি। মানে আমার মা ছিল আসল গেরিলা। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা প্রস্তাব তোলার পর তাকে গ্রেফতারের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৮ মে আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও ছয় দফা দাবির পক্ষে আন্দোলনের ডাক দিল আওয়ামী লীগ। আমার মা ই আয়োজন করলেন ৭ জুনের হরতাল। এই আন্দোলনটাকে গড়ে তোলার জন্য আমার মা সব সময় সক্রিয় ছিলেন।

আওয়ামী লীগ ছয় দফায় অটল থাকার পেছনেও বঙ্গমাতা : শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে খ্যাত বঙ্গবন্ধুর তোলা ছয় দফার বদলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারা আট দফা দাবি নিয়ে এসেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা নেতারা বাংলাদেশের অনেক নেতাকেও মানিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গমাতা বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে জানিয়েছেন সব, আর সেই বার্তা নিয়ে দিয়েছেন নেতা-কর্মীদের। বড় বড় নেতারা সব সময় মেনে যায়। তারা সবাই কনভিনসড যে আট দফাই মানতে হবে, ছয় দফার দরকার নেই। কিন্তু নেতা-কর্মীরা সবাই ছয় দফার পক্ষে। ছয় দফা ছাড়া তারা মানবে না। আব্বার সঙ্গে দেখা করে মা এসে খবর দিলেন, কোনো আট দফা করা না, ছয় দফাই ঠিক। মাঠকর্মী, ছাত্র, ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে সব সংগঠন ছয় দফার পক্ষে। ওপরের দিকে কিছু নেতা, এখন নাম বলার দরকার নাই, অনেকে বেঁচেই নাই, তারা চলে গেল ওই দিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছয় দফাই থাকল।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের পেছনে বঙ্গমাতার দৃঢ়তা : প্রধানমন্ত্রী বলেন, আব্বাকে প্যারোলে অর্থাৎ সাময়িক মুক্তি দিয়ে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছে, সেখানে যাবেন। আমাদের নেতারা যথারীতি সবাই তৈরি। আব্বাকে বোঝাতে চলে গেছেন, একখানা প্লেনসহ চলে এলেন বড়বড় হোমড়াচোমড়া নেতারা। আমি গেলাম ক্যান্টনমেন্টে। গিয়ে দেখি, নেতারা ভিতরে, আমাকে যেতে দেবে না। ওখানে ছোট কাঠের গেট, আমি গেটে দাঁড়ানো। আমি তাকাচ্ছি, আব্বা আমাকে দেখে কিনা। আব্বা আমাকে দেখে চলে এলেন কাছাকাছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর মা কী খবর দিয়েছে বল, চিঠিটিঠি কিছু দেওয়ার দরকার নেই। আমি বলেছি, মা বলে দিয়েছে, এরা প্যারোলে নিতে এসেছে। আম্মা ইন্টারভিউয়ের জন্য দরখাস্ত দিয়েছে। মা’র সঙ্গে কথা না বলে প্যারোলে যাবেন না।

বঙ্গবন্ধু গিয়ে তার সিদ্ধান্ত জানানোর পর তাকে বোঝাতে যাওয়া নেতারা তখন যান ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। সেখানে বঙ্গমাতাকে একজন বলেন, আপনি এটা কী করলেন ভাবী? আপনি এটা ঠিক করেননি। আপনি জানেন না ওনাকে তো মেরে ফেলে দেবে? কয়েক দিন আগে তো সার্জন্ট জহুরুল হককে মেরে ফেলেছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘মা শুধু বললেন, আপনি কেবল একজনকে নিয়ে চিন্তা করছেন। একজনকে মেরে ফেলেছে। আরও তো ৩৩ জন আছেন। তাদের স্ত্রীরাও তো বিধবা হবে। আমি তো তাদের কথাও চিন্তা করব। উনি প্যারোলে যাবেন কেন, তাহলে মামলা তুলতে হবে, মুক্তি দিতে হবে, তারপর উনি যাবেন। তিনি বলেন, উনি যদি সত্যি প্যারোলে যেতেন, বাংলাদেশ কখনো স্বাধীন হতো না। আমার মায়ের সময়োচিত সিদ্ধান্তই তো আমার দেশ এগিয়ে গেল।

৭ মার্চের ভাষণের আগে বঙ্গবন্ধুকে নির্ভার করেন বঙ্গমাতা : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে তার মায়ের অবদান কতটুকু তাও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ভাষণের আগে কতজনের কত পরামর্শ, আমার আব্বাকে পাগল বানিয়ে ফেলছে। সবাই এসেছে, এটা বলতে হবে, ওটা বলতে হবে। আমার মা আব্বাকে খাবার দিলেন, ঘরে নিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। মা সোজা আব্বাকে বললেন, তুমি ১৫টা মিনিট শুয়ে বিশ্রাম নিবা। অনেকেই অনেক কথা বলবে। তুমি সারা জীবন আন্দোলন করেছ, তুমি জেল খেটেছ। তুমি জান কী বলতে হবে। তোমার মনে যে কথা আসবে, সেই কথা বলবা। অন্য কারও কোনো কথা বলার দরকার নাই। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন কি না, সে নিয়ে সে সময় নানা জিজ্ঞাসা ছিল। আর এই সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের প্রস্তুতিও ছিল। তবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন পরোক্ষভাবে আর সেটি বুঝতে পারেনি পাকিস্তানিরা। শেখ হাসিনা বলেন, ওই বক্তৃতায় একটা ভুল যদি হতো, লাখ লাখ মানুষ সেদিন শহীদ হতো।

বঙ্গমাতার জন্মদিন পালিত : বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী গতকাল পালিত হয়েছে। দিবসটি এবারও জাতীয়ভাবে উদযাপিত হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল— বনানী কবরস্থানে বঙ্গমাতার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, কোরানখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা। বঙ্গমাতার জন্মদিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভার আয়োজন করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনুষ্ঠানে বঙ্গমাতার ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এর আগে সকালে বনানী কবরস্থানে বঙ্গমাতার সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে দিনের কর্মসূচি শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে সেখানে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় সাহারা খাতুন, ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, আবদুল মতিন খসরু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, এ কে এম এনামুল হক শামীম, মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, হাছান মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, তাঁতী লীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন বঙ্গমাতার সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে।

বঙ্গমাতার জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপ-কমিটির উদ্যোগে দুপুরে রাজধানীর আজিমপুরের সলিমুল্লাহ এতিমখানা মাঠে দুস্থ, এতিম ও প্রতিবন্ধীদের মধ্যে খাদ্য ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, উইমেন জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ (ডব্লিউজেএনবি), বঙ্গমাতা পরিষদ পৃথক আলোচনা সভার আয়োজন করে।

সর্বশেষ খবর