শিরোনাম
সোমবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

অভিশপ্ত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার অনিবার্য ছিল

পীর হাবিবুর রহমান

আত্মবিস্মৃত জাতির মতো আমরা ভুলে যেতে পারি না সেই অভিশপ্ত একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার কথা। সময়টা ছিল বিএনপি-জামায়াত শাসন আমলের। সারা দেশে একের পর এক গ্রেনেড বোমা হামলার মধ্য দিয়ে একদিকে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হচ্ছিল। সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী। সিলেটের হোটেল গুলশানে আওয়ামী লীগের সভায়ও বোমা হামলায় ঘটেছিল হতাহতের ঘটনা। রাজশাহীর বাঘমারা প্রায় স্বাধীন করে বাংলাভাইরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।

এক দিনে দেশের ৫০০ জায়গায় সিরিজ বোমা হামলা হয়েছিল। হামলা হয়েছে আদালতপাড়ায়ও। এক অন্ধকার সময়ের মুখোমুখি হয়েছিল দেশ।

সেদিনের নৃশংসতা ও বর্বরতার চিত্র দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে সাহসিকতার সঙ্গে জাতির সামনে উন্মোচিত করলেও সরকারের মন্ত্রীরা ছিলেন উদাসীন। মনে করেছিলেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী। বলেছিলেন বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। সেই মন্ত্রীরাও বেশি দিন ক্ষমতায় থাকেননি। যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসিতে ঝুলেছেন। সেই সময়টিতে এই বোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে শান্তি মিছিলের ডাক দিয়েছিল। দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট অপরাহ্ন। বিকাল ৪টা থেকেই নেতা-কর্মীরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত মিছিল নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন শান্তির পক্ষে। খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তি মিছিল-পূর্ব সমাবেশে বক্তৃতা করতে তৎকালীন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বুলেটপ্রুফ গাড়িতে চড়ে বিকাল ৫টার দিকে সেখানে হাজির হন। প্রায় ২০ মিনিট বক্তৃতা শেষে বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে তিনি যখন শান্তি মিছিল শুরুর ঘোষণা দিয়ে নামতে যাবেন ঠিক তখন ফটোসাংবাদিকরা ছবি তোলার জন্য এক মিনিট তাঁকে থামিয়ে দেন। আর সেই সময় শুরু হয় চারদিকে একের পর এক গুপ্ত ঘাতকের গ্রেনেড হামলা। একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে থাকে। আর মুহূর্তে মানুষের বাঁচার আকুতি চিৎকার আর রক্তের স্রোতে ভেসে যাওয়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে ওঠে এক মৃত্যুপুুরী।

ফটোসাংবাদিকদের অনুরোধে সেই মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা না থামলে গ্রেনেডে তাকেও উড়ে যেতে হতো। জীবন প্রদীপ নিভে যেত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ট্রাকে থাকা শীর্ষ নেতাদের। ট্রাকে থাকা মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান সেই সময় বেঁচে গেলেও পথের কর্মীদের সঙ্গে রাজপথে বসে থাকা তার সহধর্মিণী ও প্রখ্যাত নারীনেত্রী আইভি রহমান ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীর নিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। সেই বিভীষিকাময় অপরাহ্ন ঘাতকের গ্রেনেডে এতটাই রক্তাক্ত অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিল যে, সমাবেশে যোগ দেওয়া ২৪ জন নিরপরাধ মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। শত শত নেতা-কর্মী আর সাধারণ মানুষ ও গণমাধ্যম কর্মী আহত হন। এখনো সেই গভীর ষড়যন্ত্রের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কেউ বা অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে নিয়ে সেই প্রতিহিংসার রাজনীতির অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকের শরীরে এখনো স্প্লিন্টার অমাবস্যার রাতে বেদনায় কুঁকড়ে দেয়।

সেই গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে শেষ করে দেওয়ার যে নৃশংস মানবতাবিরোধী অপারেশন চালানো হয়েছিল সেখানে দলের নেতারা মানব বর্ম করে তাঁকে আগলে ছিলেন। দেহরক্ষী প্রাণ হারিয়েছে। তাঁকে গাড়িতে করে দ্রুত সুধাসদনে নিয়ে যেতে চাইলে সেই বুলেটপ্রুফ গাড়িতেও খুনিরা গুলি চালিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন বিদেশে থাকায় অলৌকিকভাবে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। সেদিন বেঁচে যাওয়ায় শেখ হাসিনা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দলেরই হাল ধরেননি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির বাতিঘর হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

কিন্তু ২০০৪ সালের একুশের গ্রেনেড হামলা যেন ছিল সেই ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত বর্বর অপারেশনের অংশ। শেখ হাসিনাই সেদিন সেই ঘটনায় বিমর্ষ হননি। গোটা জাতি স্তব্ধ হয়েছিল। নেতা-কর্মী আর মানুষের স্রোত নেমেছিল হাসপাতালগুলোতে। সেই ভয়ঙ্কর দিনের বেদনাবিধূর দিনটি এখনো চোখের সামনে ভাসে। ঘটনার পরদিন সচিবালয়েও অনেক মন্ত্রী যাননি। সেদিনের সরকার এ ঘটনার দায় যে এড়াতে পারে না সেই কথাটি তখনই সব মহল থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। বার কাউন্সিল গণতদন্ত কমিশন করেছিল। সরকার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নামে প্রহসন করেছিল। সেদিনের অনেক রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ব্যর্থই হয়নি, রহস্যজনক ভূমিকা পালন করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এক কথায় সেই সরকার জজ মিয়া নাটকের মধ্য দিয়ে গোটা জাতির সামনে বিতর্কিত, প্রশ্নবিদ্ধ, সমালোচিত হয়েছে। এমন কি শাসক দলের আত্মঅহংকারী নেতারা এতটাই দায়িত্বহীন বক্তব্য রেখেছিলেন যে, যখন কেউ কেউ বলেছেন আওয়ামী লীগই হামলা চালিয়েছে বা শেখ হাসিনা নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গেছেন তখন বেসামাল মনে হয়েছে।

বিশ্ববিবেক সেদিন জেগে উঠেছিল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এ ঘটনার বিচার চেয়েছেন। শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছেন। গোটা দেশের মানুষ ন্যায়বিচার চেয়েছে। যারা নিহত হয়েছেন তারা তাদের স্বজনদের এই হত্যার বিচার প্রাপ্য ছিল। যারা আহত ও পঙ্গু হয়েছেন ন্যায়বিচার তাদের মৌলিক অধিকার ছিল। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সব আবেদন, দেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করে সেদিনের দাম্ভিক বিএনপি-জামায়াত সরকার সত্যের বিপরীতে চরম মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।

২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে হৃতদরিদ্র পরিবারের চা দোকানদার জজ মিয়াকে সিআইডি তুলে নিয়ে এসে এই গ্রেনেড হামলার অপরাধী বানায়। নাটক সাজায় সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জড়িত এবং এই হামলাকারী বলে। একই বছরের ২৬ জুন ঢাকার সিএমএম আদালতে তাকে দিয়ে জবানবন্দি গ্রহণ করানো হয়। তাকে রাজ সাক্ষী করার চিন্তা থেকে তার পরিবারকে মাসে মাসে টাকাও দেয় সিআইডি।

২০০৬ সালের আগস্টেই গণমাধ্যমে জজ মিয়ার মায়ের বরাত দিয়ে এই নাটকের সত্য উদ্ঘাটিত হয়। শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। মাঝখানে চার বছর ২৬ দিন জেল খাটা নিরপরাধ নিরীহ জজ মিয়া এখন ট্যাক্সি চালায় ও নারায়ণগঞ্জে বাস করে। মাঝখানে ক্ষমতার অন্ধত্ব রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমন বর্বরচিত হামলায় কীভাবে ব্যবহূত করা হয় এবং কীভাবে সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হয় সেই সত্য জাতির সামনে উন্মোচিত হয়। জজ মিয়া নাটকের আগে পার্থ নামের এক নিরীহ যুবককে আটক করে অমানবিক নির্যাতন করে পুলিশ। জজ মিয়াকে ১৭ দিন হেফাজতে রেখে সাজানো জবানবন্দি আদায় করা হয়, বিনিময়ে পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য মাসে মাসে মাসোয়ারা ও রাজসাক্ষী করার কথা বলে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন সিআইডির কর্মকর্তারা।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই গ্রেনেড হামলার বিচারের রায় হবে। কার্যত একুশের গ্রেনেড হামলায় বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র্রে সমঝোতার আস্থা ও বিশ্বাসের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কবর রচিত হয়েছিল। এমন ভয়াবহ গ্রেনেড তাণ্ডব ও গোটা জাতির জন্য হৃদয়বিদারক রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল তা জনগণ মানতে পারেনি। দীর্ঘ ১৪ বছর পর হলেও মানুষ বিচার পাচ্ছে। সত্যের জয় হচ্ছে। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না। সেই সত্য আবার সামনে এসেছে। একুশের এই গ্রেনেড হামলার বিচার জাতির জীবনে অনিবার্য ছিল। এই বিচারের মধ্য দিয়ে জাতি অভিশাপমুক্তই হবে না, ইতিহাসে সেই সত্যকেই আবার সবার সামনে নিয়ে আসবে যে— ক্ষমতা যেমন চিরস্থায়ী নয়, তেমনি সত্যের কাছে মিথ্যা পরাজিতই নয়, অপরাধী যত শক্তিশালীই হোকে একদিন তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। বিচারের শাস্তি অপরাধীকে ভোগ করতেই হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর