বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ফাইনালে বাংলাদেশ

ফাইনালে বাংলাদেশ

দুর্দান্ত ক্যাচ ধরার পর মাশরাফিকে ঘিরে সতীর্থরা —এএফপি

ক্রিকেটের মজা বোধহয় এমনই। ভাবনাকে ছাপিয়ে উত্তেজনাগুলো ছড়িয়ে থাকে পরতে পরতে। কখন কী হবে, বলতে পারে না কেউ। কখন, কোথায় হেলে পড়বে জানে না কেউ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুলতে দুলতে পক্ষ-বিপক্ষ দুই শিবিরেই হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিতে বড় ওস্তাদ ক্রিকেট খেলাটি। আবুধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অলিখিত সেমিফাইনালটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তেজনার রেণু ছাড়িয়ে পালস বিট কখনো কখনো শয়ের ওপরে নিয়ে গেছে। শ্বাসরুদ্ধকর ও নাভিশ্বাস ওঠা ম্যাচে দুরন্ত ক্রিকেট খেলে হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছে মাশরাফি বাহিনী। ২৩৯ রান করেছিল বাংলাদেশ। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে ভোল পাল্টানো ম্যাচে ৩৭ রানে জিতে এশিয়া কাপের স্বপ্নের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে টাইগাররা। আগামীকাল এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াইয়ে দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ভারতের রোহিত শর্মা, শেখর ধাওয়ানের মুখোমুখি হবে মাশরাফি, মুশফিক, মুস্তাফিজ, মাহমুদুল্লাহর বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য জয়ে ছয় বছর আগের ২০১২ সালের ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হারের প্রতিশোধ নিল। সব মিলিয়ে এশিয়া কাপে তৃতীয়বারের মতো ফাইনাল খেলছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালে ফাইনাল খেললেও শিরোপার স্বাদ পায়নি মাশরাফি বাহিনী। অনেকগুলো নয়, সোজাসাপ্টা একটা মাত্র সমীকরণ। জয় এবং ফাইনাল। আবুধাবির শেখ জায়েদ স্টেডিয়ামের ম্যাচটি তাই রূপ নিয়েছিল অলিখিত সেমিফাইনালে। স্বপ্ন পূরণের ম্যাচ হলেও ছিল আকাশসম চাপ। সেই ম্যাচে খেলেননি বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। আঙ্গুলের ইনজুরিতে জেরবার সাকিব খেলা রেখেই ফিরে গেছেন ঢাকায়। সাকিববিহীন ম্যাচটি জিততে মরিয়া টাইগার শিবির একাদশ সাজায় তিন পরিবর্তন নিয়ে। ওপেনারদের টানা ব্যর্থতায় এক বছর পর ফিরেন বাঁ-হাতি ওপেনার সৌম্য সরকার। এক ম্যাচের বিরতি দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয় পেসার রুবেল হোসেনকে। অবশ্য এতে বাদ পড়েন বাঁ-হাতি স্পিনার নাজমুল অপু। তিন পরিবর্তনের একাদশ নিয়ে খেলতে নেমেই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। দলীয় ১২ রানে উপরের তিন ব্যাটসম্যান হারিয়ে দল যখন পুরোপুরি কোণঠাসা, অক্সিজেন নিতে হাঁসফাঁস করছে, তখনই ‘ক্রাইসিস ম্যান’ মুশফিকুর রহিম শক্ত হাতে হাল ধরেন দলের। মিথুনকে নিয়ে চতুর্থ উইকেট জুটিতে ১৪৪ রান যোগ করে দলকে নিয়ে যান বন্দরে। শ্রীলঙ্কা ম্যাচে এই স্কোরটি ছিল মুশফিকের ব্যক্তিগত স্কোর। দ্বীপরাষ্ট্রের বিপক্ষেও জুটি বেঁধেছিলেন দুজনে। তামিম ইকবালের রূপকথার ম্যাচটিতে দুজনের যোগফল ছিল ১৩১ রান। গতকাল যোগ করেন ১৪৪ রান। মিথুন সাজঘরে ফেরেন ব্যক্তিগত ৬০ রানে। মুশফিক বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে নার্ভাস নাইনটিজের শিকার হয়ে আউট হন ৯৯ রানে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, মুশফিক এশিয়া কাপেও প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ৯৯ রানে কাটা পড়েন। ৯ চারে সাজানো ১১৬ বলের ইনিংসটি সাবেক অধিনায়কের ১৯২ ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৩০ নম্বর হাফসেঞ্চুরি। মিথুনেরটি ৯ ম্যাচ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় হাফসেঞ্চুরি।

আগের ম্যাচগুলোর মতো গতকালও পুরো ব্যর্থ উপরের সারির ব্যাটসম্যানরা। রান করতে ভুল গেছেন ওপেনাররা। শ্রীলঙ্কা  ম্যাচে কব্জি ভেঙে দেশে ফিরে গেছেন তামিম। তার জায়গায় তিন ম্যাচ খেলেন নাজুমল শান্ত। কিন্তু কোনো ম্যাচেই দুই অংকের ঘরে পৌঁছাননি। তিন ম্যাচে তার রান ৭, ৭ ও ৬। আরেক ওপেনার লিটন দাসও ব্যর্থ। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪১ রান করলেও বাকিগুলোতে রান ৬, ৭ ও ১। গতকাল নাজমুলের জায়গায় এক বছর পর দলে ফেরা সৌম্য রানের খাতা খোলার আগেই ফিরে যান সাজঘরে। উপরের সারির ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতাকে মাটিচাপা দিয়ে দলকে টেনে নিয়ে যান মুশফিক, মিথুন, মাহমুদুল্লাহ। তিন ব্যাটসম্যানের দৃঢ়তায় ৭ বল হাতে রেখে ২৩৯ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। ২৪০ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে মাশরাফি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের মুখে নাভিশ্বাস ওঠে পাকিস্তান শিবিরে। টাইগাররা আক্রমণ শানায় দলের একমাত্র স্পেশালিস্ট অফ স্পিনার মেহেদি হাসান মিরাজ। মিরাজ ও মুস্তাফিজের সাঁড়াশি আক্রমণে তাল হারিয়ে ১৮ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়ে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান। সেখান থেকে দলকে টেনে নিতে চেষ্টা করেন বর্ষীয়ান ক্রিকেটার শোয়েব মালিক ও তরুণ ইমাম-উল-হক। দুজনে চুতর্থ জুটিতে যোগ করেন ৬৭ রান। সাবেক অধিনায়ক শোয়েবকে সাজঘরে ফেরত পাঠান মিড অনে মাশরাফি দুর্দান্ত এক ক্যাচ ধরে। এরপর একাই দলকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন ইমাম।

সাকিব নেই। নেই নাজমুল অপু। দু-দুটি বাঁ-হাতি স্পিনার ছাড়া বাড়তি চাপ ছিল অপরাপর বোলারদের ওপর। প্রথম ওভারে বোলিংয়ে এসেই পাকিস্তানের মূল ব্যাটসম্যান ফখর জামানকে সাজঘরে ফেরত পাঠিয়ে প্রথম আঘাত হানেন মিরাজ। এরপর জোড়া আঘাত হানেন ‘কাটার মাস্টার’ মুস্তাফিজ। মাত্র ৭ বলের ব্যবধানে বোকা বানিয়ে আউট করেন বাবর আজম ও সরফরাজকে। তিন উইকেট হারানোর পর নিজেদের হারায়ে খুঁজছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা। তার ওপর দলীয় ৩৩ ওভারের দ্বিতীয় বলে আসিফের সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেন উইকেটরক্ষক লিটন। মুস্তাফিজের বলটি আসিফের গ্লাভস ছুঁয়ে যখন উইকেটের পেছনে যায়, সহজ ক্যাচটি নিতে পারেননি লিটন। আসিফ তখন ২২ রানে ব্যাট করছিলেন এবং দলের স্কোর ছিল ৫ উইকেটে ১২৮। এরপর অবশ্য আসিফ লম্বা ইনিংস খেলতে পারেননি। দলীয় ১৬৫ রানে মিরাজের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন লিটনের স্ট্যাম্পিংয়ে। তিনি ও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ইমাম ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে যোগ করেন ৭১ রান। পরের ওভারেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা ইমামকে সাজঘরে ফেরান মাহমুদুল্লাহ। এবারও স্ট্যাম্পিং লিটনের। দু-দুটি স্ট্যাম্পিং করে ক্যাচ মিসের খেসারত পুষিয়ে দেন। সাজঘরে ফেরার আগে ইমাম নামের পাশে লিখে নেন ৮৩ রানের ইনিংস। ইনিংসটি খেলার পথে ১৫ বছর আগে মুলতানে খেলা চাচা ইনজামাম-উল হকের অবিশ্বাস্য সেঞ্চুরির কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন ইমাম। মুলতান টেস্টে সেঞ্চুরি করে একাই বাংলাদেশকে হারিয়েছিলেন ইনজামাম। গতকাল সেই পথেই হাঁটছিলেন ইমাম।  কিন্তু মুস্তাফিজ ও মিরাজের সাঁড়াশি আক্রমণের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। সাকিবের অবর্তমানে বোলিংয়ে নেতৃত্ব দিয়ে মিরাজ ১০ ওভারের স্পেলে মাত্র ২৮ রানের খরচে তুলে নেন ২ উইকেট। 

মাশরাফির নেতৃত্বে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সেমিফাইনালের পর এশিয়া কাপের ফাইনাল খেলছে বাংলাদেশ।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলাদেশ : ২৩৯/১০ (৪৮.৫ ওভার), পাকিস্তান : ২০২/৯ (৫০ ওভার)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর