রক্ত ঝরছে। লাশ পড়ছে। হাত বাড়ালেই মিলছে ঝকঝকে অবৈধ অস্ত্র। পেশাদার অপরাধী ছাড়াও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এখন সশস্ত্র কিশোর গ্যাং। খুনের পর লাশ কেটে কলিজা ও ফুসফুস বের করে গডফাদারকে উপহার দেওয়ার মতো পৈশাচিক ঘটনায় আতঙ্ক চারদিকে। খুন রক্ত আর অস্ত্র—সব মিলিয়ে ময়মনসিংহ এখন রক্তাক্ত জনপদ। সরেজমিন জানা যায়, ময়মনসিংহ নগরীতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায় উত্থান ঘটেছে শীর্ষ সন্ত্রাসীর একাধিক গ্রুপের, যাদের বিরুদ্ধে জনগণ মুখ খোলার সাহস পায় না। মাদক, অস্ত্র, চাঁদাবাজি আর রাজনৈতিক ক্যাডার ও উঠতি অপরাধীদের গ্যাংস্পট হয়ে উঠেছে আকুয়া এলাকা। নানা নামে গড়ে ওঠা অন্তত দুই ডজন গ্রুপের দৌরাত্ম্যে পুরো ময়মনসিংহ কাঁপছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনকে রহস্যজনকভাবে সম্মোহিত করে অবাধে চালানো হচ্ছে মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজিসহ বেআইনি কর্মকাণ্ড। অস্ত্রবাজ গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তার করতে গুলি ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে ওই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখছে। তারা প্রতিনিয়ত অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে নিজেদের ভয়ঙ্কর অবস্থান জানান দিতে চালাচ্ছে গুলি। মামলা দিতে চাইলে বাড়িঘরে উঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে স্বজনদের হত্যা, গুম করে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আশফাক আল রাফী শাওন (২৮)। ২৫ ফেব্রুয়ারি দিবাগত গভীর রাতে নগরীর মৃত্যুঞ্জয়ী স্কুল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। এর ১১ দিন পর তিনি মারা যান। ঘটনার সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো উদ্ধার হয়নি তাকে হত্যার কাজে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি।৩১ জুলাই আকুয়া এলাকায় প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় ময়মনসিংহ মহানগর যুবলীগের সদস্য সাজ্জাদ আলম শেখ আজাদ ওরফে আজাদ শেখকে (৩৩)। প্রথমে দুই রাউন্ড গুলি এবং পরে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এক হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই আরেক হত্যাকাণ্ড। এমন অবস্থায় জেলার নাগরিক সমাজ মনে করছে, ধীরে ধীরে সন্ত্রাসীর শহর হয়ে উঠছে ময়মনসিংহ। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধার না করাতেও উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। নিহত আজাদের সদ্য বিধবা স্ত্রী দিলরুবা আক্তার দিলু (৩২) ও আজাদের হতভাগ্য মা সুফিয়া খাতুনসহ (৫০) স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, এক সপ্তাহ আগে খুনিরা হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘আজাদ আমার মহল্লায় বাস করেও অন্য গ্রুপের রাজনীতি করে কোন সাহসে? আজাদ শেখের কলিজাটা কত বড়, সেইটা আমি দেখতে চাই।’ এ হুমকির পর থেকেই সকাল-বিকাল বিভিন্ন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা আজাদ শেখের বাড়ি চড়াও হয়ে ককটেল-বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। রাত হলেই দফায় দফায় হানা দিত থানা পুলিশ আর ডিবির টিমগুলো। এর মধ্যেই ৩১ আগস্ট দুপুরে আজাদ শেখ চুপিসারে নিজ বাড়িতে ঢুকতেই অজ্ঞাত গ্রুপের সদস্যরা আকুয়া হারুন ব্যাপারী মোড়ের বাড়িতে হানা দেয়। জীবন রক্ষার জন্য আজাদ শেখ বাড়ি থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকেন। নাজির বাড়ি মসজিদের কাছে তার ওপর গুলি চালানো হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যেতেই সেখানে বন্দুক, পিস্তল ও বিভিন্ন ধারালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অর্ধশত সন্ত্রাসী তাকে ধরে পাশেই জুবিলি কোয়ার্টার বিহারি ক্যাম্পের উল্টো দিকের গলিতে নিয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা সেখানে ধারালো ছুরি দিয়ে আজাদ শেখকে জবাই এবং পেট ও বুকে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। একপর্যায়ে সন্ত্রাসীরা তার দেহ থেকে কলিজা ও ফুসফুস বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। পরে সেই কলিজা আর ফুসফুস তাদের গডফাদারকে উপহার দিয়ে আসে খুনিরা।
অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার : বৃহত্তর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুরের সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ময়মনসিংহে ঢুকছে অবৈধ পিস্তলসহ ক্ষুদ্র অস্ত্র। মেইড ইন ইউএসএ লেখা এসব পিস্তল ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ চক্র ভারতের তৈরি করা ফাইভ স্টার পিস্তল আমদানি করে থাকে সবচেয়ে বেশি। সীমান্তে খুব একটা ধরা না পড়লেও ময়মনসিংহ শহর ও আশপাশ থেকে প্রায়ই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের খবর জানা যায়। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা স্বীকার করেন, চোরাচালান হয়ে আসা অস্ত্রের তুলনায় আটক হওয়া অস্ত্রের পরিমাণ অনেক কম। চোরাচালানে আসা অবৈধ অস্ত্রের যে পরিমাণ ময়মনসিংহে থেকে যায়, তা-ই ময়মনসিংহকে অশান্ত করে রাখে। অবৈধ অস্ত্রধারীরা রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তারা বলেন, অস্ত্র চোরাকারবারিরা সাধারণত একসঙ্গে একটা-দুইটার বেশি অস্ত্র বহন করে না। ফলে সীমান্তের যে কোনো দিক দিয়েই আসা-যাওয়ার সুবিধাটা ব্যবহার করতে পারে তারা। আকারে ছোট হওয়ায় চোরাই পথে এসব অস্ত্র আনা-নেওয়া সহজ হয় এবং সহজে লুকিয়ে রাখা যায় বলে ব্যবহারকারীরাও এসব অস্ত্র বেশি পছন্দ করে। ময়মনসিংহে অস্ত্রের বাজার আছে এ কথাটা এখানে বেশ আলোচিত। তবে এই বাজারে কীভাবে কেনাবেচা হয়, তা জানা নেই বেশির ভাগ মানুষের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত দালালরা ক্রেতা ও বিক্রেতার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। বিক্রেতারা মাল দেওয়ার আগেই টাকা আদায় করে নেয়। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে চোরাচালান সামগ্রী আটক করা হলেও অস্ত্র আটক হয় খুবই সামান্য। ময়মনসিংহে র্যাব-১৪ সদস্যরা শহরতলি থেকে নজরুল নামের এক সন্ত্রাসীকে বিদেশি পিস্তলসহ গ্রেফতার করে। এর কয়েক দিন আগে ময়মনসিংহের জেলা ডিবির সদস্যরা আবিষ্কার করেন অস্ত্রের কারখানা। ময়মনসিংহের সচেতন নাগরিকরা বলছেন, দেশের অন্য সব জেলা শহরের তুলনায় ময়মনসিংহের সন্ত্রাসীরা অনেক বেশি সশস্ত্র। প্রায়ই এখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনা যায়। সারা দেশের মতো ময়মনসিংহের অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। রাজনীতিবিদরা নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে এ কাজ করেন। অস্ত্রধারীরাও ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা চালানোর কাজে রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে। ময়মনসিংহে মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন অভিযানে সম্পৃক্ত থাকা র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও স্বীকার করে জানিয়েছেন, গত দুই বছরে উদ্ধার আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর বেশির ভাগই ছিল নতুন চকচকে। ময়মনসিংহের জেলা পর্যায়ের এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে বিভিন্ন অভিযানে ভাঙাচোরা, পুরনো এবং দেশে তৈরি পাইপগান মার্কা অস্ত্রশস্ত্রই বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু ইদানীং সন্ত্রাসীদের হাতে উঠে এসেছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আর্মস।’ তিনি জানান, প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে প্যাকেটজাত এ অস্ত্রশস্ত্র এনে দেশজুড়ে ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে।