শুক্রবার, ৫ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্ধ্যাবেলা

ইমদাদুল হক মিলন

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সন্ধ্যাবেলা

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ইলেকশন অবজারভার এসেছেন।

ছিয়ানব্বই সালের কথা। ভারত থেকে এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মনসুর আলী খান পাতৌদি আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করা হলো বাংলাদেশ থেকে। আমরা যাব বরিশাল অঞ্চলে।

সুনীলদার সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিকে একটা ঘটনা ঘটেছিল। একাশির শেষদিক অথবা বিরাশির শুরু। আমি জার্মানিতে দুই বছর কাটিয়ে ফিরেছি। সুনীলদা এসেছেন ঢাকায়। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, আমাদের প্রিয় বাচ্চু ভাই শহীদ আলতাফ মাহমুদের বাসায় এক বিকালে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ঢাকা থিয়েটারের ছেলেমেয়েরা সুনীলদার সঙ্গে আড্ডা দেবেন। তাঁর কণ্ঠে কবিতা শুনবেন। শিমুল, ইউসুফ, সুবর্ণা, আফজাল, ফরীদি, আসাদ ও পীযূষ এরকম অনেকে আছেন। আমিও আছি। আলতাফ মাহমুদ আর ঝিনু আপার মেয়ে শাওন ছোট। কে যেন ওকে বলে দিয়েছে, যা অটোগ্রাফ নিয়ে আয়। শাওন ঘুমিয়ে ছিল। ঘুম চোখে একটা খাতা আর কলম নিয়ে আমার সামনে এসে বলল, অটোগ্রাফ দাও।

আমি হতভম্ব! সুনীলদাকে দেখিয়ে ফিসফিসে গলায় বললাম, আমি না। এই যে সুনীলদা। তাঁর অটোগ্রাফ নাও।

শাওন সুনীলদার দিকে তাকালোই না। বলল, না, তুমি দাও...

আমার জন্য কী রকম বিব্রতকর অবস্থা! এই অবস্থার পিছনে একটা কারণ আছে। তখনকার দিনে ছোটদের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘কিশোর বাংলা’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সেই পত্রিকার প্রথম ঈদসংখ্যায় আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম। নাম ‘চিতা রহস্য’। শাওন সেই উপন্যাস পড়েছে। সে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে চেনে না। আমি বসে আছি সুনীলদার পাশে। ভেবেছে আমার অটোগ্রাফই নিতে হবে। এই ঘটনা নিয়ে পরে আফজাল হোসেন একটা লেখা লিখেছিলেন ‘শাওনদের চিতা রহস্য’।

অটোগ্রাফ নিয়ে ওই একবার লজ্জা পেয়েছিলাম, আরেকবার পেয়েছিলাম বাংলা একাডেমি বইমেলায়। হুমায়ূন আহমেদ এসেছিলেন আমার অটোগ্রাফ নিতে। তৃতীয় ঘটনা ওই বইমেলাতেই। আমি যে স্টলটায় বসেছি সেখানে একটু ভিড় ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছি। এক ভদ্রমহিলা আমার বই নিয়েছেন। অভ্যাসবসত বইটা টেনে নিয়ে অটোগ্রাফ দিতে গেছি, মহিলা খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, এ কী! আপনি আমার বইতে লিখছেন কেন?

মহিলা লেখক চেনেন না, অটোগ্রাফ বোঝেন না। তাঁর দরকার বই। তিনি বই কিনেছেন, আমার কী অধিকার আছে তাঁর বইতে সই করার? ভালো শিক্ষা হয়েছিল সেবার!

আমাদের একটা গাড়ি দেওয়া হয়েছে। সেই গাড়ি নিয়ে মাওয়া হয়ে বরিশাল যাচ্ছি। মাওয়ার আগের গ্রামের নাম মেদিনীমণ্ডল। আমার জন্মের গ্রাম। রাস্তার পশ্চিমপাশে কয়েকশ গজ দূরে মধ্যবিত্ত গ্রামের বাড়ি। সুনীলদাকে সেই বাড়ি দেখালাম। তিনি অপলক চোখে তাকিয়ে দেখলেন, শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পরে এ কথা তিনি ‘ধানসিঁড়ি নদীর সন্ধানে ও অন্যান্য’ বইতে লিখেছিলেন। আমি আমার বাড়ি দেখাতে পারলাম তিনি কি তাঁর বাড়ি এইভাবে দেখাতে পারবেন? তিনি মাদারীপুরের লোক। গ্রামের নাম মাইজপাড়া। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই বাড়ি! পরে অবশ্য রাজ্জাক হাওলাদার নামে এক ভদ্রলোক সুনীলদার বাড়ি উদ্ধার করেছেন। সেখানে এখন একটা পাঠাগার হয়েছে। সুনীলদার জন্মদিনে সুনীল মেলা হয়।

বরিশালে এসে সুনীলদা বললেন, ধানসিঁড়ি নদীটা দেখতে চাই আর জীবনানন্দের বাড়ি। স্থানীয় দুয়েকজনকে বলা হলো। তাঁরা বললেন, কোনো অসুবিধা নেই। ধানসিঁড়ি এই তো, কাছেই। জীবনানন্দের বাড়িও আমরা চিনি। কাল ইলেকশান। আপনারা বিভিন্ন স্পটে যাবেন। এক ফাঁকে দেখে নেবেন। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমরা ক্লান্ত। হোটেলে ফিরলাম। তেমন সুবিধার হোটেল না। একটাই দুই বেডের ভালো রুম। আমরা দুজন থাকব। কী যেন কী কারণে সুনীলদা একটু ছটফট করছিলেন। রুমে ঢুকেই ব্যাগ খুলে হুইস্কির বোতল বের করলেন। আমি তাঁর ছটফটানির কারণ বুঝলাম। প্রথম চুমুক দিয়ে ‘আহ’ বলে খুবই আরামের একটা শব্দ করলেন। ঘুমাবার আগে সুনীলদা বললেন, বুঝলে মিলন, আমার একটু নাকডাকার অভ্যেস আছে। তোমার অসুবিধা হবে না তো?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলে কথা! বিনীত গলায় বললাম, না না কিচ্ছু অসুবিধে হবে না। আপনি ডাকুন, যত ইচ্ছা নাক ডাকুন। কোনো সমস্যা নেই।

সুনীলদা নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে পড়লেন। এক-দেড় মিনিট হবে, শুরু হলো সুনীলদার নাকডাকা। শুরুটা হলো আস্তেই। রাগসংগীতের আলাপের ভঙ্গিতে। পাশের বিছানায় শুয়ে বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তিকে নিয়ে আমি ভাবছি। এতবড় লেখক শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে এভাবে ঘুমিয়ে পড়লেন? নাকডাকার শব্দও দেখি ধীরে ধীরে বাড়ছে! মিনিট কয়েকের মধ্যে সুনীলদার নাকডাকা চূড়ান্ত রূপ ধারণ করল। বাপরে! ডাক কাহাকে বলে। আমার তো ঘুম আসার প্রশ্নই ওঠে না। মনে হচ্ছে সুনীলদার নাকডাকার শব্দে এই হোটেলের সবাই জেগে উঠেছে। হোটেল ছাড়িয়ে শব্দ ছড়িয়ে যাচ্ছে পুরো বরিশাল শহরে। বরিশালবাসীর ঘুম ভাঙিয়ে কীর্তনখোলার দিকে যাচ্ছে শব্দ। কীর্তনখোলা পেরিয়ে সোজা চলে যাচ্ছে ঢাকার দিকে। ঢাকাবাসীর ঘুম ভাঙিয়ে চলে যাচ্ছে কলকাতায়। কলকাতারও সবার ঘুম ভেঙে গেছে। একটা মিনিটও ঘুমাতে পারলাম না আমি। সকালবেলা ফ্রেশ সুনীলদা হাসিমুখে বললেন, ঘুম হলো?

আমি বিনীত গলায় বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ সুনীলদা, খুবই ভালো ঘুম হয়েছে। আপনার নাকডাকার শব্দ টেরই পাইনি। সকাল ১০টার দিকে ইলেকশন অবজারভ করতে বেরোলাম আমরা। সুনীলদা বললেন, এসব দেখে আমরা কী করব? চলো ধানসিঁড়ি নদীটা দেখি। কিন্তু ধানসিঁড়ি আর খুঁজে পাই না। যাকে জিজ্ঞেস করি সেই বলে, এই তো কাছেই। ওই যে ওই রাস্তা দিয়ে চলে যান। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক খুঁজতে হলো। শেষ পর্যন্ত গ্রামের ভিতর পাওয়া গেল নদীটি। ধানসিঁড়ি আসলে এক শীর্ণখাল। দুই পাড়ে গৃহস্থজনের ঘরবাড়ি আর বাবলা গাছ। একটা নৌকা নিয়ে সেই নদীতেই আমরা কিছুক্ষণ ঘুরলাম। নিউইয়র্ক বইমেলায় গেছি। বাংলাদেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদ আর আমি, কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার। লস অ্যাঞ্জেলেসেও একটা বইমেলা হবে। নিউইয়র্কের মেলা শেষ করে আমি আর সুনীলদা সেখানে চলে গেলাম। লস অ্যাঞ্জেলেসে আমার ছোটবোন থাকে। গেন্ডারিয়ার নাসের লিটনরা থাকে। লিটন আমার ছোটভাই খোকনের বন্ধু। লিটন আছে আমাদের সঙ্গে। ওর খুব ইচ্ছা সুনীলদাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। বললাম সুনীলদাকে। রাজি হলেন। একফাঁকে বললাম, সুনীলদা, ওদের বাড়িতে কিন্তু পান করার ব্যবস্থা নেই। ওরা পছন্দও করে না। সুনীলদা বললেন, কোনো অসুবিধে নেই। চলো।লস অ্যাঞ্জেলেসের দীর্ঘ সন্ধ্যা। লিটনদের বাড়িতে আপ্যায়নের অভাব নেই। চা-কফি নানা রকমের জুস, কোক, বিস্কুট ও ফল। সুনীলদা কোনোটাই ধরছেন না। আমি টুকটাক খাচ্ছি। সুনীলদাকে দেখি মাঝে মাঝে উসখুস করছেন। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। সুনীলদা এমন করছেন কেন? একটা সময়ে প্যান্টের পিছনের পকেটে হাত দিয়ে চ্যাপটা মতন মাঝারি সাইজের একটা বোতল বের করতে করতে বললেন, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি আর পারছি না। লিটনদের বাড়িতে এসব চলে না। ওরা সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগল। এক চুমুক খেয়ে সুনীলদা সিগ্রেট ধরালেন। তোমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?

অসহায় মুখ হাসি হাসি করে লিটন বলল, না না ঠিক আছে। আপনি খান।

সর্বশেষ খবর