শুক্রবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

বিমল করের মেয়ে

ইমদাদুল হক মিলন

বিমল করের মেয়ে

লিউকেমিয়া নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস পড়েছিলাম ‘খড়কুটো’। লেখক বিমল কর। খুবই মন খারাপ করা উপন্যাস। একটা বয়সে আমরা, বন্ধুরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থেকেছি ‘খড়কুটো’ নিয়ে। নায়কের নাম অমল, নায়িকা ভ্রমর। ভ্রমর নামটাও আমাদের চমত্কৃত করেছিল।

খড়কুটোর একটি অংশের কথা সবসময় মনে পড়ে। শেষ দুপুরে নির্জন একটি ঘরে মৃদু মোলায়েম স্বরে গান গাইছে ভ্রমর। ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা, আমি যে পথ চিনি না’। অমল যাচ্ছে ওই ঘরের পাশ দিয়ে। হঠাৎ শোনে ভ্রমরের মিষ্টি বিষণ্ন গান। শুনে ওই ঘরে ঢুকে গেছে। অমলকে দেখে গান থামিয়েছে ভ্রমর। দুজনার মধ্যে নিরুচ্চারিত এক ভালোলাগা তৈরি হয়েছে ততদিনে। গানের রেশ ধরে অমল বলল, এই সখাটা কে?

ভ্রমর বলল, কেন ভগবান!

শুনে অমলের মুখটা বিষণ্ন হলো। ও, আমি ভেবেছিলাম আমি।

ভ্রমর স্নিগ্ধ গলায় বলল, তুমিও।

বেশ কয়েকবার ‘খড়কুটো’ আমি পড়েছি। বোধহয় খড়কুটোই আমার পড়া বিমল করের প্রথম উপন্যাস। ওই এক উপন্যাসেই তাঁর মহাভক্ত হয়ে গেলাম। তারপর যেখানে বিমল করের যে লেখা পাই, পড়ে ফেলি। দেওয়াল, অসময়, পূর্ণ অপূর্ণ, বালিকা বধূ, গ্রহণ, দংশন, যদুবংশ, মোহ, এ আবরণ, এইসব উপন্যাস। আর গল্প, পলাশ, সুধাময়, আত্মজা, আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন। ততদিনে বিমল কর সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিও। তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় কাজ করেন। দেশ পত্রিকার গল্প নির্বাচন করেন। তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ লেখকদের সঙ্গে তুমুল আড্ডা দেন।

সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এলেন ’৯০ সালের দিকে। পরিচয় হলো, ঘনিষ্ঠতা হলো। কথায় কথায় সন্তোষকুমার ঘোষের কথা উঠল, গৌরকিশোর ঘোষ, বিমল কর এসব শ্রদ্ধেয় লেখক সাংবাদিকের কথা উঠল। সমরেশদা বললেন, এই তিনজনের মেয়েই এখন ‘বর্তমান’ পত্রিকায় আছে। সন্তোষ ঘোষের মেয়ে কাকলি চক্রবর্তী। ওর স্বামী কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তী হচ্ছেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ছেলে। গৌরকিশোর ঘোষের মেয়ে সাহানা নাগচৌধুরী, বিমল করের ছোটমেয়ে অনুভা কর। অনুভার ডাকনাম ‘পুচুন’। ওরা সবাই ‘বর্তমান’ পত্রিকায়।

সমরেশদা কলকাতায় ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর কাকলি চক্রবর্তীর চিঠি পেলাম। সাপ্তাহিক বর্তমানের জন্য গল্প চেয়েছেন। সমরেশদাই তাঁকে বলে ব্যবস্থা করেছেন। গল্প লিখলাম। নাম ‘মানুষের আড়ালে মানুষ’। এই গল্প পড়ে অনুভা চিঠি লিখল। সে আমার গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছে। সে নাকি আমার আরও কিছু লেখা পড়েছে। আমার ভক্ত। অনুভার চিঠি পেয়ে আমি একেবারে আত্মহারা। বিমল করের মেয়ে আমাকে চিঠি লিখেছে? আমিও লিখলাম। এইভাবে শুরু হলো। গেলাম কলকাতায়। কলকাতা তেমন ভালো চিনি না। গিয়ে উঠেছি টালিগঞ্জের টলিক্লাবে। এখানে বাংলা সাহিত্যের তিন দিকপালের তিন কন্যার সঙ্গে পরিচয় হলো। কাকলি চক্রবর্তী, সাহানা নাগচৌধুরী আর অনুভা কর। একেকদিন একেকজন এসেছিলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। অনুভা এলো দুপুরের মুখে মুখে। এসেই বলল, এ আপনি কোথায় উঠেছেন? এটা তো কলকাতা না!

তার মানে চৌরঙ্গি, শ্যামবাজার এইসব এলাকা থেকে অনেক দূরে টালিগঞ্জ। পরে অবশ্য সমরেশদা এখান থেকে আমাকে চৌরঙ্গির ওদিককার তাঁর বন্ধু নীহারদার হোটেলে নিয়ে তুলেছিলেন।

টলিক্লাবে দুুপুরে অনুভাকে নিয়ে খেতে ঢুকেছি। একটা টেবিলে মুখোমুখি বসেছি দুজনে, ক্লাবের এক কর্মচারী, স্যুট-টাই পরা, এসে বিনীতভাবে বললেন, স্যার, আপনার পায়ে চটি। চটি পরে এখানে ঢোকা যায় না। ওটা দয়া করে বদলে আসুন।

বড় ক্লাবগুলোর এইসব কেতা আমি জানি। অনুভা আসার ফলে একটু দিশাহারা হয়েছি। তাকে নিয়ে ডাইনিংয়ে এসে ঢুকেছি, পায়ে স্যান্ডেল, ভুলেই গেছি। এমন লজ্জা পেলাম! অনুভা কিছু ভাবলই না। হাসিমুখে বলল, কী আর করা! আমি বসলুম, আপনি চটি বদলে আসুন।

আমি রুমে গিয়ে জুতো পরে এলাম। তারপর এমন বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে আমরা দুজন অনেকক্ষণ গল্প করলাম। অনুভা খেল না কিছুই। শুধু কফি। আমি খেলাম দুপুরের খাবার। অনুভা বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণের স্নিগ্ধ সুন্দর মেয়ে। কথা বলে খুব মিষ্টি করে। দুপুরটা আমাদের খুব ভালো কাটল।

সেবার হোটেল এসটোরিয়ায় এক দুপুরে আমার অনারে পার্টি দিল ‘বর্তমান’। বর্তমানের অনেকেই ছিলেন। হাসির লেখা লিখে মাত করে দিয়েছেন সেই বিখ্যাত লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ছেলে অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়ও কাজ করে বর্তমানে। ওর সঙ্গে পরিচয় হলো। মনে আছে, একটা প্লেটে করে নিজের পছন্দের খাবারগুলো আমাকে সেদিন এনে দিয়েছিল অনুভা। তার পর থেকে অনুভা মাঝে মাঝে চিঠি লেখে, আমি লিখি। কয়েকবার ওদের বাড়িতে ফোনও করেছি ঢাকা থেকে। বেশির ভাগ সময়ই ফোন ধরতেন অনুভার মা। সুন্দর কণ্ঠে, পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলা মানুষ। কণ্ঠে যেন আনন্দটা লেগেই আছে। আমার সঙ্গে টুকটাক কথা বলেই অনুভাকে ডেকে দিতেন। একদিন ফোন ধরলেন বিমল কর। বিমল করের গলা শুনে আমি ভড়কে গেলাম। ঢোক গিলে বললাম, আমি ঢাকা থেকে। মিলন।

বিমল কর সরল গলায় বললেন, ইমদাদুল হক মিলন। আরে আমার মেয়ের মুখে তো শুধুই তোমার কথা শুনি। একটু ধর, ডেকে দিচ্ছি।

ওটুকুই কথা।

যে বছর কলকাতা বইমেলায় আগুন লাগল, সম্ভবত ’৯৫ সাল, আমি তখন কলকাতায়। বিকালবেলা মেলার দিকে রওনা দিয়েছি, দেখি গাড়ি-ঘোড়ার মহাজট লেগেছে, বইমেলার ওদিক থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। একজন পথচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে দাদা?

বইমেলায় আগুন লেগেছে। ওদিকপানে যাবার চেষ্টা করবেন না।

আমি হতভম্ব হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করব এখন? অনুভার কথা মনে হলো। অনুভাদের বাড়ি যাই। ওর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আসি। অনুভাকে ফোন করলাম। বলল, চলে আসুন। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা সল্টলেক। অনুভা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। দোতলায় ড্রয়িংরুমে নিয়ে বসাল। আমি উদ্গ্রীব হয়ে আছি বিমল করকে দেখার জন্য। বলতে হলো না। অনুভা বুঝল। বলল, বাবা অসুস্থ। ঘুমিয়ে আছেন। ডাক্তার তাঁকে কথা বলতে বারণ করেছেন।

আমার মন খারাপ হলো। পাশের ঘর পর্যন্ত এসেও বিমল করের সঙ্গে দেখা হলো না। ফেরার সময় অনুভা আমাকে কিশোরকুমারের গানের ছয়টা ক্যাসেটের সুন্দর গিফটবক্স উপহার দিল। তখনো অনুভার বিয়ে হয়নি। তারপর বিয়ে হলো। অনুভার সঙ্গে একটা গ্যাপ হয়ে গেল আমার। কয়েক বছর যোগাযোগই নেই।

২০০৯ সালের ১৪ এপ্রিল, ১ বৈশাখ থেকে ঢাকা কলকাতা ট্রেন সার্ভিস চালু হলো। ট্রেনের নাম ‘মৈত্রী’। এ উপলক্ষে আনন্দবাজার একটা আয়োজন করল। কলকাতা থেকে যে ট্রেনটা আসবে সেই ট্রেনে করে ঢাকায় আসবেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আর ঢাকা থেকে যে ট্রেনটা যাবে সেই ট্রেনে যাব আমি। আসতে যেতে শীর্ষেন্দুদা আর আমি দুটো লেখা লিখব, লেখা দুটো পরদিন আনন্দবাজারের ফার্স্ট পেজে ছাপা হবে। আমি আনন্দবাজারের হয়ে কলকাতায় চলে গেলাম। ট্রেনে বসে লেখা যে কী কঠিন কাজ, জীবনে প্রথম টের পেলাম। পরদিন আনন্দবাজারের ফার্স্ট পেজে ছাপা হলো লেখা। একপাশে শীর্ষেন্দুর একপাশে আমার। এতদিন পর কলকাতায় গেছি, বন্ধুরা যোগাযোগ করতে লাগল। আনন্দবাজার যে হোটেলে রেখেছিল সেখানে ছুটে এলো ছোটদের জনপ্রিয় লেখক দীপ মুখোপাধ্যায়, আমার প্রকাশক এবং অতিপ্রিয় বন্ধু প্রদীপকুমার সাহা। আনন্দবাজারের হোটেল ছেড়ে আমি গিয়ে উঠলাম ‘চৌধুরী গেস্ট হাউস’-এ।

কলকাতা তখন বেগুনি হয়ে আছে জারুল ফুলে।

চৌধুরী গেস্ট হাউসের পশ্চিম দিকটায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। রাস্তার দুই পাশে অজস্র জারুল গাছ। তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। এক বিকালে ওদিককার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। দীপের ছোট্ট মারুতি গাড়িতে আমি দীপ মুখোপাধ্যায় আর প্রদীপ সাহা। প্রদীপকে বললাম, অনুভার সঙ্গে দেখা করতে হবে। অনেকদিন অনুভার সঙ্গে যোগাযোগ নেই, দেখা নেই।

প্রদীপ ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকাল। কার সঙ্গে দেখা করবেন?

অনুভার সঙ্গে।

আপনি জানেন না?

কী জানব?

অনুভাদি তো মারা গেছেন।

আমার বুকটা ধক করে উঠল। কী?

হ্যাঁ। অনুভাদি মারা গেছেন দুই বছর আগে। ক্যান্সার হয়েছিল।

আমি আর কথা বলতে পারি না, আমি আর প্রদীপের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার শুধু অনুভার কথা মনে হয়, আমার শুধু বিমল করের কথা মনে হয়। ক্যান্সার রোগগ্রস্ত বিষণ্ন ভ্রমরকে নিয়ে তিনি ‘খড়কুটো’ লিখেছিলেন। তাঁর কোমল বিষণ্ন মিষ্টি অনুভাই শেষ পর্যন্ত ভ্রমর হয়ে গেল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর