শনিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
প্রার্থী চূড়ান্ত অপেক্ষা ঘোষণার

পরিবর্তনের আপিল শেখ হাসিনার কাছে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কে পাচ্ছেন আর কে বাদ পড়ছেন তা এখন কমবেশি জেনে গেছেন তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। চূড়ান্ত ঘোষণার আগে নিজ এলাকায় ‘প্রার্থী পরিবর্তনের আপিল’ নিয়ে হাজির হচ্ছেন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও সংগঠনের জেলা-উপজেলার নেতৃস্থানীয় নেতারা। কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে চলেছেন তারা। দলীয় প্রধানকে কাছে পেয়ে কেউ কেউ আবেগে আপ্লুত হয়েছেন। আবার কেউ কেউ দল ও জোটের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাই যে গণভবনে আসছেন এমনও নয়। কেউ কেউ নিজ এলাকার দায়িত্বশীল নেতাদের পাঠিয়ে তদবির করছেন। সারা দেশ থেকে আসা এ ধরনের নেতারা দলীয় সভানেত্রীর নরম-গরম উত্তর নিয়ে ফিরছেন। বুধ, বৃহস্পতিবার এবং গতকাল রাতেও গণভবনে ছিল মনোনয়নপ্রত্যাশী ও তাদের পক্ষে তদবিরকারী নেতার ভিড়।

বৈঠকসূত্রগুলো বলছেন, মনোনয়নবঞ্চিতরা প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে মন খুলে কথা বলেছেন। এতে শুধু দলীয় প্রার্থী পরিবর্তনই নয়, জোটের প্রার্থী না করার পক্ষেও জোরালো যুক্তি তুলে ধরেন কেউ কেউ। আবার কেউ কেউ সম্ভাব্য প্রার্থীকে বিজয়ী করার আশ্বাস দেন। তাদের কথা শুনে সবার উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সব যোগ্যতা থাকার পরও অনেককেই মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ একজন প্রার্থীকে প্রতীক দিতে হবে। যিনি সবচেয়ে যোগ্য তাকেই প্রার্থী করা হচ্ছে। যারা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের আগামীতে দল ক্ষমতায় এলে নানাভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এজন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলকে ক্ষমতায় আনার তাগিদ দেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে জোটের ঐক্য অটুট রেখে প্রার্থীকে বিজয়ী করার নির্দেশ দেন তৃণমূলের প্রতি।

গত বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে কথা বলতে আসেন তৃণমূলের দেড় শতাধিক নেতা। এর অনেকেই ছিলেন মনোনয়নপ্রত্যাশী। আবার বর্তমান সংসদেরও একাধিক এমপি ছিলেন তাদের সঙ্গে। গণভবনের পশ্চিম মাঠে রাত ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত বৈঠকে দীর্ঘ সময় নেতাদের কথা শোনেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। বৈঠকসূত্র জানান, সুনামগঞ্জ-১ আসনের এমপি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন তালিকায় তিনিই এগিয়ে। তবে তাকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায় না তৃণমূল আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম শামীম প্রধানমন্ত্রীর সামনে বলেন, ‘নেত্রী! ২০০৮ সালে একজন অপরিচিত এবং আওয়ামী লীগ পরিবারের নয় এমন একজনকে প্রার্থী করে পাঠালেন। আমরা তাকে বিজয়ী করেছি। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও ভোট দিয়ে পাস করিয়েছি। এমপি সাহেব বিএনপিকেই শক্তিশালী করেছেন। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ জায়গায় নৌকার প্রার্থীর বিপরীতে বিকল্প প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন; যার ফলে ১৬টিতে নৌকার প্রার্থী ফেল করেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে যদি তাকে প্রার্থী করা হয়, তাহলে কেউ তার পক্ষে থাকবে না। যিনি স্থানীয় নির্বাচনে নৌকার বিরোধিতা করেছেন, তাকে নৌকা দিলে পরাজয়ের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না।’ একই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী রফিকুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমার বাবা চারবারের এমপি ছিলেন। আমার বাবার আমলে কোনো গ্রুপিং ছিল না। কিন্তু এখন একাধিক গ্রুপিং তৈরি হয়েছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে এমপি নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। এ আসনের তিনটি উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী এমপির সঙ্গে নেই। নেত্রী! আপনি বিকল্প প্রার্থী দিন। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করব।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী সব মনোনয়নপ্রত্যাশীকে এক হয়ে একজনের নাম দিতে বলেন। একইসঙ্গে জরিপে তাদের অবস্থান ভালো হলে বিবেচনায় নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি। নেত্রকোনা-৩ আসনে এবার মনোনয়ন তালিকায় রয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দলের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। এ আসনে দলের মনোনয়ন চান জেলা কৃষক লীগের সভাপতি কেশব রঞ্জন সরকার। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে নির্বাচনী এলাকায় নিজের কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে কান্নাকাটি করেন। নিজেকে যোগ্য প্রার্থী হিসেবে তাকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানান। কেশবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে কেন্দুয়া পৌর মেয়র আসাদুজ্জামান বলেন, ‘নেত্রী! আমরা শুনতে পাচ্ছি আপনি একজন ত্যাগী, কারানির্যাতিত কেন্দ্রীয় নেতাকে নৌকা দিচ্ছেন। তিনি যোগ্য প্রার্থী। আমরা কথা দিচ্ছি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করে আসনটি উপহার দেব।’ অসীম কুমার উকিলের পক্ষে কেন্দুয়া পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুল বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, ‘অসীম কুমার উকিল নিয়মিত এলাকায় যাচ্ছেন এবং নেতা-কর্মীদের আপদ-বিপদে পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তাকে নৌকা দিলে জয় নিশ্চিত।’ ঝিনাইদহ-২ আসনে এবার দলের মনোনয়ন পেয়েছেন স্বতন্ত্র এমপি তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দশম সংসদ নির্বাচনে এ আসনে নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সাবেক এমপি সফিকুল ইসলাম অপু প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছে। জবাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘তোকে তো ২০১৪ সালে দলের মনোনয়ন দিয়েছিলাম। কিন্তু পাস করলি না। সেবার পাস করলি না, এবার পাস করবি কীভাবে?’ অপু বলেন, ‘তাহজীব আলম সিদ্দিকী বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। তার পক্ষে জামায়াত-বিএনপি কাজ করেছে। মশিউরের গ্রুপ তার পক্ষে কাজ করে জিতিয়েছে।’ জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তুই কেমন রাজনীতি করিস! সবাই তোর বিপক্ষে কাজ করে।’ এ সময় অপু আরও বলেন, ‘নেত্রী! ওরা তো সংস্কারবাদী। আপনাকে নানা গালিগালাজ করে।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমাকে তো অনেকেই গালি দিয়েছে। আমি যখন জেলে ছিলাম তখন অনেকেই আমার বিরুদ্ধে কাজ করেছে। দলে সংস্কার চেয়েছে। আমি তো তাদের মাফ করে দিয়ে এমপি-মন্ত্রী বানিয়েছি। পাশে বসিয়েছি। আমি কোনো কিছুই ভুলে যাইনি। সব মনে আছে। দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে আমি সহ্য করে যাচ্ছি। আমার একটাই চাওয়া— দেশের মানুষের মঙ্গল।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেখানে যে প্রার্থী বিজয় লাভ করে আসার মতো সেখানে তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নিচ্ছি। যাকে নৌকা দিচ্ছি তার পক্ষে কাজ কর।’

গোপালগঞ্জ-১ আসনের বর্তমান এমপি কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান। এবারও তিনি দলের মনোনয়ন পাচ্ছেন। এ আসনে নৌকা পেতে চান দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুকুল বোস। অন্যান্য মনোনয়নপ্রত্যাশীর মতো তিনিও ছিলেন বৃহস্পতিবার গণভবনে। অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মতো তিনিও বক্তৃতায় নিজের ত্যাগের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘নেত্রী! আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর প্রতিবাদ করেছিলাম। এ কারণে অনেক নির্যাতন-জুলুমের শিকার হয়েছি।’ তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছ, আবার ১৯৮১ সালে আমার দেশে ফেরার বিরোধিতাও করেছ! ১/১১-এর সময় সংস্কারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলে। কী এসব করনি?’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, জবাবে মুকুল কোনো কথা বলেননি।

ঢাকা-১৪ আসনের এমপি আসলামুল হক আসলামের বিরুদ্ধে দলের নেতা-কর্মীদের এড়িয়ে চলা, নিজস্ব বলয় তৈরির অভিযোগ তোলেন কাউন্দিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলমগীর হোসেন। এ ছাড়া আসলাম ঋণখেলাপি হওয়ার শঙ্কার কথা বলেন তিনি। সে কারণে নতুন মুখকে মনোনয়ন দিতে বলেন।

ঢাকা-১৪ আসনে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছেন সংরক্ষিত আসনের এমপি সাবিনা আকতার তুহিন।

সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান এমপি গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘৬৯ সালে তাড়াশ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। মুক্তিযুদ্ধ শেষে দুবার ইউপি চেয়ারম্যান, দুবার উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলাম। ২০১৪ সালে উপনির্বাচনে আমাকে মনোনয়ন দিয়ে এমপি বানিয়েছেন। আমি নির্বাচনী এলাকার সংগঠনগুলো গুছিয়েছি। রায়গঞ্জের পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করেছি, যা আগে কখনো জিততে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছি। এবার আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। ৬৯ বছর বয়সের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আপনার কাছে নৌকা চেয়ে বিদায় নিচ্ছি।’ জানা গেছে, মিলনের বক্তৃতার প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। নেত্রকোনা-২ আসনে এবার নৌকা পেতে যাচ্ছেন বর্তমান এমপি আরিফ খান জয়। তবে তাকে প্রার্থী না দেওয়ার দাবি করেন এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী শামসুর রহমান ওরফে ভিপি লিটন।

গণভবনে উপস্থিত ঢাকা মহানগরী উত্তর যুবলীগের সভাপতি মাইনুল হোসেন খান নিখিল, সংরক্ষিত আসনের এমপি সাবিনা আকতার তুহিনসহ কয়েকজন বক্তৃতা দিতে চাইলেও প্রধানমন্ত্রী তাদের থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘তোমরা ঢাকার। তোমরা কথা বলার সুযোগ পাও। যারা কথা বলার সুযোগ পায় না তাদের সুযোগ দাও।’

সর্বশেষ খবর