রবিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

২০ মিনিটে তৈরি হয় ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’

কামাল লোহানী

২০ মিনিটে তৈরি হয় ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’

মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যেকটি ঘটনাই স্মরণীয়। এর মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে আবেগময় দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। সে বছর আমার জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এনে দিয়েছিল ১৬ ডিসেম্বর।

এদিন বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্তে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য সংবাদ, গান ইত্যাদি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। সেদিন মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে আমাদের প্রতিদিনকার মতো অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকতে বলা হলো। আমাদের তখন মনে হলো এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে। আমাদের ধারণা হলো মুক্তিবাহিনী হয়তো পাকবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছে। বেতার কেন্দ্র থেকে আমরা তখন এ বিষয়ে কোথাও কোনো আলোচনা হচ্ছে কিনা তা শুনতে তৎপর হলাম। আমরা শুনতে পেলাম যে, ১৬ তারিখ বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করবে। আর এ কথা শোনা মাত্রই আমরা ভীষণভাবে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। উল্লসিত কণ্ঠগুলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে থাকল। আমাদের এই উল্লাস দেখে আশপাশে দু-একটা বাড়ি থেকে আমাদের জন্য মিষ্টি পাঠানো হলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণত দুপুরের পর থেকে বেতার কেন্দ্রের কোনো অধিবেশন ছিল না। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম সেদিন দুপুরে (১৬ ডিসেম্বর) বেতার কেন্দ্র থেকে বিজয়ের স্লোগান ও গান প্রচার করব। যেহেতু আমি সংবাদ বিভাগের প্রধান ছিলাম তাই সেদিনের জন্য চূড়ান্ত সংবাদটিও লিখে ফেললাম। সেই সংবাদ রেকর্ড করার কথা বাবুল আকতারের। কিন্তু সেদিনের সেই বিশেষ সংবাদটি পাঠের জন্য একজন সংবাদ পাঠকের কণ্ঠস্বরে যে উত্থান-পতনের প্রয়োজন তা বাবুলের ছিল না। আমার সহকর্মীরা তখন বিশেষ এই সংবাদটি আমাকে পাঠ করতে অনুরোধ জানাল। আর সংবাদটি পাঠ করে আমার অদ্ভুত ধরনের এক অনুভূতি তৈরি হলো। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে। আর এই সংবাদটি সারাবিশ্বের মানুষের কাছে আমার কণ্ঠের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে, এটি ভাবতেই আমার কাছে অদ্ভুত এক শিহরণ লাগল। ঘটনাটি একই সঙ্গে আমার কাছে ছিল প্রচণ্ড গর্ব ও গৌরবের। সে সময় আমাদের ২নং স্টুডিওতে সহযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম গান লেখালেখির কাজ করছিলেন আর কণ্ঠশিল্পী অজিত রায় নিজের কণ্ঠে তুলছিলেন। মাত্র ১৯-২০ মিনিটে তারা সেদিন দেশের ঐতিহাসিক গান ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ কণ্ঠে তোলার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছিলাম সে  গৌরবকে ৪৭ বছর ধরে রাখতে আমাদের নানা বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছে। দেশে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের মতো বিষবাষ্প ছড়িয়ে যাচ্ছে। তবে তারুণ্যের শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণরা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। অনুলিখন : জিন্নাতুন নূর

সর্বশেষ খবর