বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

হিংসামুক্ত সমৃদ্ধ দেশ গড়বে বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক

হিংসামুক্ত সমৃদ্ধ দেশ গড়বে বিএনপি

‘ক্ষমতায় গেলে কারও ওপরই কোনো প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। চলমান উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না। একটি প্রতিহিংসামুক্ত এবং সহমর্মী বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হবে বিএনপির লক্ষ্য। তবে মেগা প্রকল্পে ব্যয়ের আড়ালে ‘সংঘটিত দুর্নীতি নিরীক্ষা’ করে দেখা হবে। গতকাল রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণাকালে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। উন্নত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯ দফা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এর আগে সোমবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার প্রকাশিত হয়। গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক দল বিএনপি গতকাল পৃথকভাবে এ নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে।

এ ছাড়া রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী না রাখার বিধান প্রণয়ন ও দেশের উন্নয়নের জন্য বহুমুখী ও উন্নততর কর্মসূচি গ্রহণ করার কথাও ইশতেহারে বলা হয়েছে।

ইশতেহারে মির্জা ফখরুল বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং চেয়ারপারসনসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের ঘরে ফেরার সুযোগ করে দিতে ভোট প্রার্থনা করেন দেশবাসীর কাছে। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনাদের একটি ভোট আমাদের নেত্রীর জীবনকে পুনরায় আলোয় উদ্ভাসিত করবে।

ইশতেহার ঘোষণাকালে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল প্রমুখ নেতা উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী কী করবে দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সেসব তুলে ধরেন মহাসচিব। বিএনপির এ ইশতেহারের বেশির ভাগই আগের দিন ঘোষিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারের সঙ্গে মিল রয়েছে।

বিএনপির ইশতেহারে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সম্পর্কে বলা হয়, নির্বাচনের দিনটিকে বিএনপি গণতন্ত্রের নিত্যদিনের অনুশীলনে পরিণত করবে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনবে। বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার দেবে। সংসদে উচ্চকক্ষ গঠন ও গণভোট পুনঃ প্রবর্তন করবে। নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো প্রবর্তন করবে। প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গঠনের জন্য জাতীয় কমিশন গঠন করবে। এ ছাড়া ন্যায়পাল নিয়োগ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) পুনর্গঠন, পুলিশ ও আনসার ছাড়া শর্তসাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা উঠিয়ে দেওয়া, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যাতায়াতের সময় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও রয়েছে।

নিম্ন আদালতকে সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত করার কথা বলা হয়েছে এ ইশতেহারে। এ ছাড়া বিচারব্যবস্থার সংস্কারে জুডিশিয়াল কমিশনের কথা ইশতেহারে বলা হয়েছে। ইশতেহারে মতপ্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল, বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল, গুম-খুন ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণসহ বাজেটের ৩০ শতাংশ স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে।

দীর্ঘ নয় পৃষ্ঠার এ ইশতেহারে বিএনপি মহাসচিব দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড সম্পর্কে বলেন, ‘এ মুহূর্তে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আমাদের সঙ্গে নেই। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে একটি পরিত্যক্ত ভবনে নির্জন কারাবাস করছেন।’ আর তারেক রহমান সম্পর্কে তিনি বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণেই দেশে ফিরতে পারছেন না। তিনি তাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় জনগণের কাছে বিএনপির পক্ষে ভোট চান।

ইশতেহারে বলা হয়, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে, সামরিক বাহিনী ছাড়া শর্তসাপেক্ষে সরকারি চাকরিতে কোনো বয়সসীমা থাকবে না, ত্রিশোর্ধ্ব শিক্ষিত বেকারদের জন্য বেকার-ভাতা চালু করার জন্য রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার নিরিখে একটি কমিশন গঠন করা হবে। দেশে একদলীয় শাসনের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, তা নিশ্চিত করা হবে। বর্তমান বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একটি জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করা হবে।

বিএনপি মহাসচিব অভিযোগ করে বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা একটি জনপ্রতিনিধিত্বহীন সরকার গঠন করে। গত প্রায় ১০ বছরে দেশে কোনোরকম সুশাসন ও আইনের শাসন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মামলা-হামলা, গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ভীতি ও ত্রাসের রাজত্ব। জনগণের বাক?স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, এ রকম একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ লড়াই শুধু নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের নয়, এ লড়াই অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। এ লড়াই ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুক্ত জীবনে এগিয়ে যাওয়ার লড়াই। ভোটারদের উদ্দেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘এ মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা নিজেদের ঘরে থাকতে পারছেন না। তারা নিজের ঘরে ফিরতে চান। পেতে চান পরিবারের সান্নিধ্য, একটি স্বস্তিময় রাত। আপনাদের সমর্থন ঘরছাড়া এই মানুষগুলোকে ঘরে ফেরার সুযোগ করে দেবে। অবসান ঘটাবে জুলুম ও নির্যাতনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।’

যা আছে বিএনপির ইশতেহারে

প্রতিরক্ষা ও পুলিশ : প্রতিরক্ষা ও পুলিশের জন্য বিশেষ সুবিধার কথা বলা হয়েছে ইশতেহারে। এতে বলা হয়, সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা হবে, যুদ্ধাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কেনা হবে। বর্তমান ও সাবেক সশস্ত্র বাহিনীর কর্মরত সবাইকে যৌক্তিক রেশনিং দেওয়া হবে এবং কল্যাণমূলক প্রকল্প নেওয়া হবে। পুলিশের ঝুঁকিভাতা বাড়ানো হবে। ইন্সপেক্টর ও সাব-ইন্সপেক্টরদের বেতন ছয় মাসের মধ্যে আপগ্রেড করা হবে।

মুক্তিযোদ্ধা : মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বিএনপির ইশতেহারে। এতে বলা হয়, ক্ষমতায় গেলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটানো হবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের ভাতা বাড়ানো হবে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা ও বধ্যভূমি-গণকবর চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে।

যুব, নারী ও শিশু : ইশতেহারে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত তরুণদের স্বার্থ রক্ষায় ইয়ুথ পার্লামেন্ট গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অধিকসংখ্যক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া হবে।

শিক্ষা : বিদেশি ভাষা শিক্ষায় জোর দেওয়া হবে। স্বল্প সুদে শিক্ষা ঋণ দেওয়া হবে। বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্যও ঋণ দেবে বিএনপি। ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। খতিব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের সম্মানি ভাতা দেওয়া হবে। প্রশ্ন ফাঁস রোধে ভূমিকা নেওয়া হবে। ভ্যাটবিরোধী, কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সব মামলা তুলে নেওয়া হবে। প্রথম তিন বছরে ২ লাখ সরকারি চাকরি দেওয়া হবে, তরুণ দম্পতি ও উদ্যোক্তাদের ২০ বছর মেয়াদি ঋণ দেওয়া হবে। পাঁচ বছরে ১ কোটি নতুন কর্মসংস্থান করা হবে।

তথ্য ও প্রযুক্তি : তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ভিওআইপি ব্যবস্থায় উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হবে। পর্যায়ক্রমে স্মার্ট সিটি, স্মার্ট পৌরসভা, স্মার্ট গ্রাম ও স্মার্ট ক্যাম্পাস গঠন করা হবে।

বিএনপি মহসচিব বলেন, প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। সংবিধানের এই নীতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনায় যাবতীয় পদক্ষেপের ভিত্তি হবে রাষ্ট্রের মালিকদের মালিকানা সুদৃঢ় করা। শুধু নির্বাচনে জেতা দলের উদ্দেশ্য নয়, বরং রাষ্ট্রের এই মালিকানায় সব দল, ব্যক্তি ও মতাদর্শ অন্তর্ভুক্ত হবে।

সর্বশেষ খবর