শনিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

ধানের শীষে দুর্নীতি, নৌকায় সমৃদ্ধি

গুলশানের বিশাল জনসভায় শেখ হাসিনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ধানের শীষে দুর্নীতি, নৌকায় সমৃদ্ধি

গুলশান-২ নম্বরের ইয়ুথ ক্লাব মাঠে গতকাল বিশাল জনসভায় বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ধানের শীষে ভোট মানেই দুর্নীতি, ধানের শীষে ভোট মানেই এক দিনে ৫০০ জায়গায় বোমা হামলা। ধানের শীষে ভোট মানেই জঙ্গিবাদ, এতিমের টাকা আত্মসাৎ, মানি লন্ডারিং। অন্যদিকে নৌকা মানেই সমৃদ্ধি, নৌকা মানেই উন্নতি, নৌকা মানেই স্বাধীনতা, নৌকা মানেই মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ও কল্যাণ। কাজেই এটা বিবেচনা করে আমি দেশবাসীর কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই। আজকে নৌকার পালে হাওয়া লেগেছে। আজকে যে জোয়ার উঠেছে, ইনশা আল্লাহ নৌকার জয় হবেই। সরকার গঠন করে মানুষের সেবা করব, উন্নত জীবন দেব। গতকাল বিকালে গুলশান-২-এর ইয়ুথ ক্লাব মাঠে তার দলের নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন শেখ হাসিনা। জনসভায় তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত রাজধানীর সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পক্ষে ভোট চেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নৌকায় ভোট দেওয়ার সুফল এখন দেশবাসী পাচ্ছে। নৌকায় ভোট দিয়েছিল বলেই আজকে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। নৌকায় ভোট দিয়েছিল বলেই স্বাধীনতা এসেছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেয়েছে। নৌকায় মানুষের মুক্তি মেলে। বিএনপি-জামায়াতের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি-জামায়াত দুর্নীতি করেছে, লুটপাট করেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। আইভি রহমানসহ আমাদের ২২ জন মারা গেছেন। বহু নেতা-কর্মী শরীরে স্প্লিন্টারের আঘাত পেয়েছেন। বহু কষ্টের মধ্যে আছেন তারা। যারা মারা গিয়েছেন, তাদের পরিবারের কথা একবার চিন্তা করুন। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে আমরা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে মানুষের উন্নয়নের কাজ হাতে নিলাম। পাঁচ বছর দেশের মানুষের কল্যাণে অনেক প্রকল্প নিলাম। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি-জামায়াত অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করল। এরপর ২০১৫ সালে খালেদা জিয়া তার অফিসে এসে ঘোষণা দিলেন সরকার পতন না হলে তিনি ঘরে ফিরবেন না। সারা দেশে অসংখ্য মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করলেন। বাস ড্রাইভারকে থামিয়ে পেট্রল ঢেলে হত্যা করলেন। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা নিজেরাই একবার চিন্তা করে দেখুন, কোনো মানুষ কি কখনো কাউকে পুড়িয়ে মারতে পারে? তারা জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তারা মসজিদে পর্যন্ত আগুন দিয়েছে। সারা দেশে ৩ হাজার ৯০০ গাড়ি পুড়িয়েছে। বাস পুড়িয়েছে, লঞ্চ পুড়িয়েছে, প্রাইভেট কার পুড়িয়ে, ট্রেন পুড়িয়েছে, সিএনজি পুড়িয়েছে। বাস, ট্রাকের ভিতর থেকে ড্রাইভার-হেলপারদের বের করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্কুলের শিক্ষার্থী, ছোট শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায়নি। মানুষ জীবন ভিক্ষা চেয়েছে, তারা দেয়নি। এরপর মানুষ যখন প্রতিরোধ গড়ে তুলল তখন নাকে খত দিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া। মানুষ তার ডাকে সাড়া দেয়নি। বিকাল ৩টায় জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও জুমার নামাজের পরপরই বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল নিয়ে উত্তর সিটি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা জনসভাস্থলে আসেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই হাজার হাজার নেতা-কর্মীর উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় ইয়ুথ ক্লাব মাঠ। মাঠের দুই পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে। তারা মাইকে দলীয় সভানেত্রীর কথা শোনেন। ঢাকা উত্তরের আট প্রার্থী এবং যুবলীগ, ছাত্রলীগের শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। নারীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। কাঠ ও ফাইভার দিয়ে তৈরি নৌকা ছিল দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকাল ৩টা ৪৪ মিনিটে জনসভাস্থলে আসেন। বিকাল ৪টা ২৬ মিনিটে বক্তৃতা শুরু করে মোট ৩১ মিনিট বক্তৃতা করেন। এ বক্তৃতায় তাঁর সরকারের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি আগামীতে সরকার গঠনের জন্য নৌকায় ভোট চান। বক্তৃতার একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, ঢাকা-১১ আসনের প্রার্থী এ কে এম রহমত উল্লাহ, ঢাকা-১২ আসনের আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা-১৩ আসনের সাদেক খান, ঢাকা-১৬ আসনের ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, ঢাকা-১৮ আসনের অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট চান। ঢাকা-১৪ আসনের আসলামুল হক আসলাম, ঢাকা-১৫ আসনের কামাল আহমেদ মজুমদার উপস্থিত না থাকলেও তাদের পক্ষে ভোট চান প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে ঢাকা-১ আসনের প্রার্থী সালমান এফ রহমানকেও পরিচয় করিয়ে দিয়ে নৌকায় ভোট চান শেখ হাসিনা। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলামকে উত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশনের আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত নির্বাচনী সভায় সংগঠনের সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহর সভাপতিত্বে ও উপপ্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানার পরিচালনায় বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আতিকুল ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, যুবলীগ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওছার, ঢাকা-১৭ আসনের প্রার্থী আকবর হোসেন পাঠান ফারুক, মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ঢাকা-১৩ আসনের প্রার্থী সাদেক খান, ঢাকা-১৬ আসনের প্রার্থী ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ, গুলশান থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী সুলতান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক হেদায়েত উল্লাহ, বনানী থানা সভাপতি জসিম উদ্দিন, সাধারণ মীর মোশাররফ হোসেন, উত্তর ছাত্রলীগ সভাপতি ইব্রাহিম হোসেন, সাধারণ সাইদুর রহমান হৃদয় প্রমুখ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মাটিতে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের স্থান হবে না। আমরা শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ চাই। আমাদের আরেকবার সুযোগ দিন দেশের শান্তি-নিরাপত্তার জন্য, দুর্নীতি দমন করার জন্য। কারণ আমরা ইশতেহার ঘোষণা দিয়েছি, দেশের জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস দূর করব। দুর্নীতি দূর করব। মানুষের কল্যাণ করব। জঙ্গিবাদ দমন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই গুলশানে যখন হলি আর্টিজানে হামলা হলো, সবাই ধারণা করেছিল এর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কিন্তু মাত্র আ-নয় ঘণ্টায় আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। সে কারণে অনেককে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে এ কাজটি সহজ ছিল না। এর পর থেকে আমরা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছি। জঙ্গিবাদ দমন করেছি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা আগুনে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করে তারা অমানুষ। এই অমানুষরা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বাংলাদেশ দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অর্থ পাচার করেছে। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে অর্থ পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে বিলাসবহুল জীবনের কী অর্থ থাকতে পারে? দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ১০ ট্রাক অস্ত্র— তারা কী করেনি? অথচ তারা এখন ধানের শীষে ভোট চায়। যারা মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে না, তারা কীভাবে আবার ধানের শীষে ভোট চায়? দেশবাসীর কাছে আমার এটাই প্রশ্ন। বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে বর্তমান সরকারের অবদানের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি আরও বলেন, আধুনিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ দুর্নীতি করতে ক্ষমতায় আসে না। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী দল হিসেবে বিএনপিকে চিহ্নিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে এতিমের টাকাও নিরাপদ নয়। আজকে তিনি সাজা পেয়ে কারাগারে। এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করলে শাস্তি তো পেতেই হবে, এটা তো কোরআন শরিফেই লেখা আছে। এতিমের অর্থ, এতিমের সম্পদ চুরি করে খেও না। এটা কোরআন শরিফের বিধান। সেটাও তারা মানে না।

বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকায় আমি জানি অনেক বস্তিবাসী রয়েছেন। এই বস্তিবাসীরা মানবেতর জীবনযাপন করেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজকে যে অবস্থায় তারা বসবাস করবেন, সে অবস্থা থাকবে না। তারা যাতে ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতে পারেন বহুতল ভবন করে ফ্ল্যাট নির্মাণ করে তাদের জন্য আমরা সেই ব্যবস্থা করব। দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক ভাড়ায় তারা থাকতে পারবেন সেই প্রকল্প গ্রহণ করেছি। মানুষ যাতে নাগরিক সুবিধা পায় সেজন্য বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। ঢাকার নাগরিক সুবিধা বাড়াতে মেট্রোরেল হচ্ছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে। পাতাল ট্রেন করে দেব। এসব নিয়ে কাজ চলছে। আগামীতে ক্ষমতায় এসে বাস্তবায়ন করতে চাই। এজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী ট্যানেল, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করতে চাই। যে পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই সেতু নির্মাণ করতে চাই। দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়তে চাই। আপনারা কি নৌকায় ভোট দেবেন? এ সময় উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ দুই হাত নেড়ে প্রধানমন্ত্রীকে হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আজকে নৌকার পালে হাওয়া লেগেছে। আজকে যে জোয়ার উঠেছে ইনশা আল্লাহ নৌকার জয় হবেই। সরকার গঠন করে মানুষের সেবা করব, উন্নত জীবন দেব— এই ওয়াদা রেখে যাচ্ছি। তিনি বলেন, ২০২০ সালে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব। এ দুই বছর মুজিববর্ষ ঘোষণা দিয়েছি। আমরা সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে চাই, তখনই পালন করতে পারব, যখন আমরা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসব। নৌকা মার্কায় ভোট দিন, আমরা জনগণের সেবা করতে পারব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর