সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

টিকে গেল জামায়াত ভোটে বিএনপি

২৫ জনের প্রার্থিতা বাতিলের সুযোগ নেই : ইসি সচিব, খালেদাসহ ১৪ প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ আজ, প্রচারণায় বাধার অভিযোগ

মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী ও আরাফাত মুন্না

অবশেষে টিকে গেলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে তারা শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকতে পারেন কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। গতকাল নির্বাচন কমিশন জামায়াত নেতাদের ভোটে থাকার পক্ষে মত দিয়ে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে। এদিকে ভোটের আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি থাকলেও এখনো আটঘাট বেঁধে প্রচারণায় মাঠে নামতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোট। ধানের শীষের বেশ কয়েকজন প্রার্থী এখনো আদালতের দ্বারে ঘুরছেন। তাদের প্রার্থিতা নিয়ে জটিলতা কাটেনি। ইতিমধ্যে তিনটি আসনে বিএনপির প্রার্থীশূন্য হয়েছে। আজ উচ্চ আদালতে দলের প্রধান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ ১৪ জনের ভাগ্য নির্ধারণ হবে। তবে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের প্রচারে বাধাসহ নানামুখী প্রতিকূল পরিবেশ থাকলেও ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর অবস্থানও একই রকম। জামায়াতে ইসলামীর ২২ জন নেতা ধানের শীষ প্রতীক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এই প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিলের আইনগত কোনো সুযোগ নেই বলে গতকাল জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) কার্যালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানান, আওয়ামী লীগ চায় বিএনপি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াক। তারা বিনা বাধায় আবারও ক্ষমতায় যেতে চায়। এ জন্য তফসিলের পরও নজিরবিহীনভাবে সারা দেশে গ্রেফতার অভিযান চলছে। ধানের শীষের ১৬ জন প্রার্থী কারাগারে। ভোটের এক সপ্তাহও বাকি নেই, এখনো অন্তত ৫০ জন প্রার্থী আদালতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। নেতারা বলছেন, আমাদের সামনে অনেক বাধা। তারপরও তা মোকাবিলা করতে আমরা প্রস্তুত। যদি ভোটের মাঠ মোটামুটি সুষ্ঠু হয়, তবুও ধানের শীষ প্রার্থীরা জয়লাভ করবেন। তারা জানান, বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখেই নির্বাচন চায় সরকারি দল। কিন্তু এবার সরকারকে খালি মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি ফলাফল পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকবে। শেষ মুহূর্তে সারা দেশে গণজোয়ার সৃষ্টি করা হবে। তবে ভোটে সরকারি দলের অনেক সুবিধা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশের বাইরে। লাখ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা। হত্যা-গুমও করা হচ্ছে। নির্বাচনের এক সপ্তাহও বাকি নেই, ধানের শীষের প্রার্থীকে মাঠেই নামতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতেও আমরা বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে নির্বাচনের মাঠে থাকতে চাই। তবে শেষ পর্যন্ত থাকব কিনা তা নির্ভর করবে সরকারের আচরণের ওপর।’  বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব অবশ্য আশা প্রকাশ করে বলছে, আজ থেকে সারা দেশে সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে। এতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। নির্বাচন কমিশন এখনো ন্যূনতম লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি যে ধানের শীষের প্রার্থীরা ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালাবেন। তবে আজকের পর থেকেই দল ও জোটের প্রার্থীরা রাজধানীর অলি-গলি চষে বেড়াবেন। জানা যায়, সেনা মোতায়েনের পর নির্বাচনী মাঠ কেমন হয়, তা দেখতে চাইছেন দলীয় নেতারা। সে জন্য আজ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে বিএনপি। সেনা মোতায়েনের পর পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূল মনে হলে নির্বাচনী মাঠে পুরোদমে নামবেন ধানের শীষের প্রার্থীরা। তবে দলটি আশঙ্কা করছে, ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত দলীয় নেতা-কর্মী ও এজেন্টদের বাড়িতে থাকতে দেওয়া হবে না। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গ্রেফতার, নির্যাতন, দমন-পীড়ন চালিয়ে সরকার বিএনপিকে নির্বাচন থেকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ হবে। বিএনপি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে এবং সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত মোকাবিলা করবে। তিনি বলেন, ৩০ ডিসেম্বর জনগণ নৌকাকে প্রত্যাখ্যান করবে। সারা দেশে ধানের শীষের পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তা দেখে সরকার দিশাহারা হয়ে গেছে।

গতকাল ঢাকা-৪ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রচারণা চালানোর সময় ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা ৩০ তারিখ সকাল সকাল ভোট কেন্দ্রে এসে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে যাবেন। আপনার ভোট সুরক্ষিত রাখতে আমরা ভোট কেন্দ্রে থাকব। কোনোক্রমেই কেন্দ্র ছাড়ব না। ফল নিয়ে তবেই ঘরে ফিরব।’

খালেদাসহ ১৪ প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ আজ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ১৪ প্রার্থী অংশ নিতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানা যাবে আজ। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওপর হাই কোর্টের স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে গতকাল আপিল করেন এসব প্রার্থী। আর খালেদা জিয়া আপিল করেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ সংক্রান্ত রিট আবেদন খারিজের বিরুদ্ধে। আজ আপিল বিভাগের অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতির আদালতে আবেদনগুলো নিষ্পত্তি হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়া অন্য প্রার্থীরা হলেন— রংপুর-১ আসনে আসাদুজ্জামান বাবলু, নাটোর-১ মঞ্জুরুল ইসলাম, জয়পুরহাট-১ ফজলুর রহমান, নওগাঁ-১ সালেক চৌধুরী, ঝিনাইদহ-২ আবদুল মজিদ, রাজশাহী-৫ আবু সাঈদ চাঁদ, ময়মনসিংহ-৮ মাহমুদ হাসান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ মোসলেম উদ্দিন, জামালপুর-৪ ফরিদুল কবির তালুকদার শামীম, রাজশাহী-৫ নাদিম মোস্তফা, ঢাকা-১ খন্দকার আবু আশফাক, বগুড়া-৭ আসনের মোরশেদ মিল্টন। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ-১ আসনে বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আবদুল হামিদ ডাবলুর প্রার্থিতা স্থগিত করে এস এ জিন্নাহ কবীরকে ধানের শীষ প্রতীক বরাদ্দের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রংপুর-১ আসনে আসাদুজ্জামান ও ময়মনসিংহ-৮ আসনে মাহমুদ হাসান ছাড়া সবাই বিএনপি মনোনীত প্রার্থী।

খালেদা জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭ এবং ফেনী-১ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। কিন্তু দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা তার মনোনয়নপত্রগুলো বাতিল করে দেন। পরে ৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনে আপিলের শুনানির পর সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার তিনটি আসনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে গিয়ে কোনো সাড়া না পেয়ে আপিল করেছেন তিনি।

জামায়াতের ২২ জনের প্রার্থিতা বাতিলের সুযোগ নেই : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের যে ২২ জন ধানের শীষ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রার্থিতা বাতিলের আইনগত কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। ২০০৮ সালের ১ আগস্ট তরীকত ফেডারেশনের দায়ের করা এক রিট মামলার রায়ে হাই কোর্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে। নিবন্ধন বাতিল হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এ দলের নেতারা এবার তাদের জোটসঙ্গী বিএনপির মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। স্বতন্ত্র হিসেবেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন কয়েকজন। ধানের শীষ নিয়ে জামায়াতের ২২ নেতার নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিটের শুনানি নিয়ে গত মঙ্গলবার বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাই কোর্ট বেঞ্চ রুলসহ আদেশ দেয়। জামায়াত নেতাদের প্রার্থিতা বাতিলের পদক্ষেপ নিতে ওই চার রিটকারী নির্বাচন কমিশনে যে আবেদন করেছিলেন, তা তিন দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলা হয় ওই আদেশে।

গতকাল নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো সমস্যা নেই। আসনগুলো হলো— ঠাকুরগাঁও-২ আসনে মাওলানা আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ মোহাম্মদ হানিফ, দিনাজপুর-৬ মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম, নীলফামারী-২ মনিরুজ্জামান মন্টু, নীলফামারী-৩ মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, গাইবান্ধা-১ মাজেদুর রহমান সরকার, সিরাজগঞ্জ-৪ মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, পাবনা-৫ মাওলানা ইকবাল হুসাইন, ঝিনাইদহ-৩ অধ্যাপক মতিয়ার রহমান, যশোর-২ আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন, বাগেরহাট-৩ অ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ, বাগেরহাট-৪ অধ্যাপক আবদুল আলীম, খুলনা-৫ অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, খুলনা-৬ মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, সাতক্ষীরা-২ মুহাদ্দিস আবদুল খালেক, সাতক্ষীরা-৩ মুফতি রবিউল বাশার, সাতক্ষীরা-৪ গাজী নজরুল ইসলাম, পিরোজপুর-১ শামীম সাঈদী, ঢাকা-১৫ ডা. শফিকুর রহমান,  কুমিল্লা-১১ ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, চট্টগ্রাম ১৫ আ ন ম শামসুল ইসলাম ও কক্সবাজার-২ আসনে হামিদুর রহমান আযাদ।

সর্বশেষ খবর