সোমবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

দেশের জন্য দিন-রাত কাজ করছি রাতেও সরকারি নথিপত্র দেখি

গৌতম লাহিড়ী, দিল্লি ফিরে

দেশের জন্য দিন-রাত কাজ করছি রাতেও সরকারি নথিপত্র দেখি

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি কখনো আমার পরিবার নিয়ে ভাবি না। আমার কাছে সবার আগে দেশ। দেশের উন্নয়নের জন্য দিন-রাত এক করে কাজ করছি। রাতেও আমাকে নিয়মিত সরকারি নথিপত্র পড়তে হয়। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে দেশ আজ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশের জেগে ওঠার সময়। প্রগতির পথের এ যাত্রা বন্ধ করা চলবে না। আমি আমার জনগণকে বিশ্বাস করি। তারা জানে আমি দেশের জন্য কাজ করব। জনগণ সুযোগ দিলে আমি আমার ক্ষমতার মেয়াদকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষ উদযাপন করতে চাই।

গত সপ্তাহে ঢাকায় ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বেসরকারি বাসভবন ‘সুধা সদন’-এ তার এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি। এ সময় ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’-এর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি হিসেবে আমি গৌতম লাহিড়ী ছাড়া আরও তিন ভারতীয় সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে ভারতীয় সাংবাদিক দলের সঙ্গে এটাই ছিল তার প্রথম সাক্ষাৎকার। শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিট কথা হয় আমাদের। তিনি নির্বাচন, রাজনীতি, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নিয়ে সুস্পষ্ট অভিমত ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে শেখ হাসিনার সেই কথোপকথন তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : জনগণ কেন আপনাকে ভোট দেবে?

শেখ হাসিনা : সাফল্যের জন্য। প্রধান প্রধান সাফল্য হলো, দশক ধরে গণতন্ত্র টিকে রয়েছে, সমুন্নত হয়েছে। স্থিতিহীন করার অপচেষ্টা সত্ত্বেও সরকার চলমান। গণতন্ত্র চলমান না থাকলে দেশের উন্নয়ন করা যায় না। স্বাধীনতার তিন বছর পর আমার বাবাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ভাগ্যক্রমে আমরা রক্ষা পাই। এরপর ১৯ বার ক্যু-দেতা হয়েছে। বার বার জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। আমরা চাই গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। আমরা দরিদ্রতা কমিয়েছি, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। জনগণের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানোর চেষ্টা করেছি। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা প্রতিটি খাতে, বিশেষত সামাজিক খাতের সমস্যাবলির সমাধান করেছি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদরাও বিষয়টি স্বীকার করেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : কী কী সুযোগ আপনারা সৃষ্টি করেছেন?

শেখ হাসিনা : আমরা বিনিয়োগের দুয়ার খুলেছি। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তাদের সুন্দর জীবন গড়ার সুযোগ তৈরি করেছি। প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অতিক্রম করে এখন ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। আমরা যখন ক্ষমতায় আসি তখন কোনো উন্নয়ন ছিল না। ওটা ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রবৃদ্ধির উচ্চ হার এবং নিয়ন্ত্রিত মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোকে দৃঢ়তা দিয়েছে। তাই জনগণ উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে। আমি এখন পদ্মা সেতু স্থাপনের অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে চাইছি। এ সেতু হয়ে গেলে প্রবৃদ্ধি আরও এক দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। সে জন্যই দেশবাসীর কাছে আমার আবেদন— দেশ এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের নির্বাচিত করুন।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় আপনি হতাশ?

শেখ হাসিনা : তিস্তা নিয়ে কী মন্তব্য করব। আপনাদের সরকারই তো আমাকে বলেছিল। আপনাদের দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমি আস্থাশীল। সৌভাগ্যবশত আপনাদের অভিজ্ঞতা আমাদের মতো নয়। আপনাদের তো কখনো স্বৈরশাসন ছিল না। বকেয়া যত সমস্যা তার সমাধান শুধু গণতান্ত্রিক সরকারই করতে পারে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির কথা কেউ কি ভেবেছে? আমার দেশের একশ্রেণির মানুষ রটিয়েছিল, আমাকে দিয়ে স্থলসীমান্ত চুক্তি হবে না। কিন্তু ওই দুটি চুক্তি হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিস্তা সমস্যারও সমাধান হবে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : দেখা যাচ্ছে, এখানে নির্বাচনে তিস্তা কোনো বড় ইস্যু নয়। অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর নিষ্পত্তি কীভাবে হবে মনে করেন। 

শেখ হাসিনা : পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একবার আমাকে কথা দেন, সমস্যার সমাধান করবেন। আমি তার সীমাবদ্ধতা বুঝি। বিষয়টিকে এখন নৈতিকতা দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশ যেহেতু ভাটির দেশ, সেহেতু ভৌগোলিকভাবে ভারত পানি আটকে রাখতে পারে না। তবে বাস্তবতা হলো, পানির ঘাটতির একটা সমস্যা রয়েছে। আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে জরুরি ভিত্তিতে নদী ড্রেজিং করতে বলেছি। বাংলাদেশে আমরা এ কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমরা এখানে পানি সংরক্ষণ করছি। ভারতকেও এটা করতে হবে। উজানে নদীতে প্রচুর বালু। এই বালু দিয়ে ভারত স্মল ব্লক ব্রিক শিল্প গড়ে তুলতে পারে। দুই দেশের যৌথ নদী কমিশন এর ওপর কাজ করছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : রোহিঙ্গা সংকটকে কীভাবে দেখেন? আপনি একবার অং সান সু চিকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, তিনি সমাধান করবেন না।

শেখ হাসিনা : গরিব রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর কারণে তারা বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়েছে। ১৯৭১ সালে ভারত লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় দিয়ে আমাদের সাহায্য করেছিল। আমরাও সেভাবে এসব দুর্ভাগাকে আমাদের দেশে ঠাঁই দিয়েছি। মিয়ানমার আমাদের পড়শি। আমরা তার সঙ্গে কলহ-বিবাদ চাই না। সে তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিক, এটাই তাকে বোঝাচ্ছি। ভয় আর বৈরী পরিবেশের কারণে ওরা বাংলাদেশ থেকে যেতে চায় না। মিয়ানমার সরকারকে আমি বলেছি, ওরা যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তোমরা তৈরি কর। রোহিঙ্গাদের জন্য আমরা পরিচয়পত্র চালু করেছি। তবুও গৃহহীন মানুষের বিপথগামী হওয়ার একটা আশঙ্কা তো থেকেই যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এখন রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চাপ দিচ্ছে।

মিয়ানমারে ১৪৩টি নৃ-গোষ্ঠী। ওরাও সংঘাতে লিপ্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে সচেষ্ট আছেন অং সান সু চি। যখন দেখি সবাই তার সমালোচনা করছে, আমার খারাপ লাগে। মিয়ানমারে গণতন্ত্র আনার জন্য তার সংগ্রামের দিকটা কী করে উপেক্ষা করি! ওখানে ক্ষমতার দণ্ডধারী তিনি বটে, কিন্তু সরকারের ওপর এখনো সেনাবাহিনীর লোকদের প্রভাব। মিয়ানমারকে রাজি করাতে ভারত আরও সচেষ্ট হোক, এটাও আমি চাই।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : রাজনৈতিক পদ্ধতির দুর্নীতির ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

শেখ হাসিনা : ওরা তো আমায় ফাঁসাতে চেয়েছিল। কিন্তু কিছুই প্রমাণিত হয়নি। এটা আমার দেশ। আমার বাবা এই দেশ আমাদের দিয়ে গেছেন। আমরা দুর্নীতিতে লিপ্ত হব কেন? অনেকেই আমার কাছে আসেন তাদের ছেলে-মেয়ের কল্যাণের জন্য। আমি কখনো আমার পরিবার নিয়ে ভাবি না। আমার কাছে সবার আগে দেশ। আমার ছেলে, আমার বোনের ছেলে, ওরা নিজেদের পড়ালেখার ব্যবস্থা নিজেরা করেছে। আমার কিছুই করতে হয়নি। নিজের ক্যারিয়ার ওরা নিজেরাই গড়েছে। ওরা বিদেশে লেখাপড়া করে সুশিক্ষিত। লেখাপড়া চালানোর জন্য ওরা ঋণ করেছে, ঋণ শোধ করার জন্য পরে চাকরিতে ঢুকেছে। এখন দেশের জন্য তারাও কাজ করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং আধুনিক বাংলাদেশ কীভাবে গড়া যায়, সেই পরামর্শ তারা দিচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : জয়ের ব্যাপারে আপনি কতটুকু বিশ্বাসী?

শেখ হাসিনা : আমি আমার জনগণকে বিশ্বাস করি। তারা জানে আমি দেশের জন্য কাজ করব। আমি আমার ক্ষমতার মেয়াদকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বর্ষ উদযাপন করতে চাই। এখন বাংলাদেশের জেগে ওঠার সময়। প্রগতির পথের যাত্রা বন্ধ করা চলবে না।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি তো খুবই ব্যস্ত। অবসর সময়টা কীভাবে কাটান?

শেখ হাসিনা : সময় কোথায়! সুযোগ পেলে বই পড়ি আর গান শুনি। রাতে সরকারি নথিপত্র আমাকে পড়তেই হয়।

বাংলাদেশ প্রতিদিন : শুনেছি আপনি রান্না করতে ভালোবাসেন।

শেখ হাসিনা : হ্যাঁ, হ্যাঁ। নাতিরা যখনই আসে, ওরা রান্না করার জন্য বায়না ধরে। এমনকি কীভাবে রান্না করতে হবে তা-ও বাতলায়। ওরা বাঙালি খাবার পছন্দ করে। আমার রান্না আমাদের বৌদেরও পছন্দ। প্রতিটি নাগরিক তার পছন্দমতো বাস করতে পারবে দেশটাকে সেভাবে নিরাপদ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ব— এটাই আশা।

সর্বশেষ খবর