শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

আবু ইসহাকের অভাবনীয় আগমন

ইমদাদুল হক মিলন

আবু ইসহাকের অভাবনীয় আগমন

একটি উপন্যাস লিখে দুটো বিশাল কাজ করলেন আবু ইসহাক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্থানটি চিরকালীন করে ফেললেন এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলার সর্বস্তরের পাঠকহৃদয় জয় করলেন। তাঁর সেই উপন্যাসের নাম ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি পাঠক এই উপন্যাস পড়ে এক মহান লেখককে আবিষ্কার করলেন। ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। আমার জম্মে র বছর। একাধারে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের প্রকাশক নওরোজ কিতাবিস্তান। তারও বহু বছর পরে চলচ্চিত্রায়িত হলো সূর্য দীঘল বাড়ী। আশির দশকের কথা। যৌথভাবে এই উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করলেন শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের। চলচ্চিত্রটিও হলো অসামান্য। ব্যাপকভাবে সম্মানিত এবং গ্রহণযোগ্য হলো। বাংলা ভাষার যে কজন লেখক প্রথম লেখাতেই সাহিত্যে স্থায়ী আসন গড়েছেন এবং ব্যাপক পাঠকের কাছে পৌঁছেছেন আবু ইসহাক সেই গুটিকয় লেখকের একজন। দীর্ঘজীবনে লিখেছেন খুব কম। তিনটি মাত্র উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘জাল’, ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’। দুটো গল্পের বই ‘হারেম’ ও ‘মহাপতঙ্গ’। আরেকটি বই আছে তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত। সেই বইটির নাম ‘স্মৃতি বিচিত্রা ও অগ্রন্থিত গল্প’। ‘মহাপতঙ্গ’ বইটি তিনটি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। বাংলা একাডেমির হয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিধানেরও কাজ করেছিলেন আবু ইসহাক। এনএসআইর উচ্চপদে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। দেশের বাইরেও সরকারি দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। লেখক হিসেবে যেমন ছিলেন অসাধারণ, মানুষ হিসেবেও ছিলেন তেমনি। অত্যন্ত সাদামাটা সরল জীবনযাপন করতেন। জীবনদৃষ্টি ছিল প্রকৃত শিল্পীর। এত বড় লেখক হওয়ার পরও অহংকার কখনো তাঁকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করেনি। লেখার লোভে বইয়ের পর বই লেখেননি। চাইলেই তিনি তা পারতেন। এই লোভ সংবরণ করার ক্ষমতা কজন লেখকের থাকে?

এই লেখকের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ ঘটল আমার। পরিচয়ের প্রথম দিনই আমার কাছে গল্প চাইলেন কবি রফিক আজাদ। তিনি তখন বাংলা একাডেমির পাক্ষিক পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’-এর সম্পাদক। গল্প লিখতে বসে আমি দেখি সেই লেখা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। রফিক ভাইকে গিয়ে বললাম, খেলা বড় হয়ে যাচ্ছে। কী করি? তিনি বললেন, যতটুকু লিখেছ দিয়ে যাও। পড়ে দেখি। কদিন পর বললেন, এই লেখা যত বড় হয় হোক, আমি ছাপব। জোর করে লেখা ছোট করো না। প্রায় বছর দেড়েক ধরে উত্তরাধিকারে রফিক ভাই সেই লেখা ছাপলেন। আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ লেখা হলো এই ভাবে। বিস্ময়কর ঘটনা হলো উত্তরাধিকারে তখন আরেকটি ধারাবাহিক উপন্যাস ছাপা হচ্ছিল। সেই উপন্যাসের নাম ‘মুখর মাটি’। লেখক আবু ইসহাক। কী সৌভাগ্য আমার! আমার জম্মে র বছরে যাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যপ্রেমী মানুষ এবং বিদগ্ধজন যে লেখককে মাথায় তুলে রেখেছেন, সেই লেখকের পাশাপাশি ছাপা হচ্ছে আমার উপন্যাস! ভাবা যায়!

‘মুখর মাটি’ পড়ে আবিষ্ট হয়ে থাকতাম। চরজীবন নিয়ে বাংলা সাহিত্যের দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস তত দিনে আমি পড়ে ফেলেছি। একটি উপন্যাসের নাম ‘চর কাশেম’ লেখক অমরেন্দ্র ঘোষ। আরেকটি ‘ইলিশমারির চর’ লেখক আবদুল জব্বার। আবদুল জব্বার বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘বাংলার চালচিত্র’ লিখে। পশ্চিমবঙ্গের লোক। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লিখতেন ‘বাংলার চালচিত্র’। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন স্তরের মানুষ, তাদের পেশা ও জীবনযাপন প্রণালিই ছিল এই লেখার বিশেষত্ব। এখনো মনে আছে, ‘বৃহন্নলা সংবাদ’ লেখাটির কথা। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে লেখা এক অসামান্য রচনা। যে চরের জীবন অমরেন্দ্র ঘোষ ও আবদুল জব্বারের লেখায় পেলাম তার চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিক ভঙ্গিতে ‘মুখর মাটি’ লিখে যাচ্ছিলেন আবু ইসহাক। লেখার পরতে পরতে বড় লেখকের হাতের ছোঁয়া। কিন্তু বই করার সময় ‘মুখর মাটি’ নামটি তিনি বদলে দিলেন। নাম করলেন ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’। বইটি বেরোলো ‘মুক্তধারা’ থেকে।

রফিক আজাদের রুমেই ইসহাক ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমি যেমন আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম ‘মুখর মাটি’, তিনিও পড়ছিলেন আমার ‘যাবজ্জীবন’। পরিচয়ের মুহূর্তেই প্রশংসা করলেন আমার লেখার। লেখার ভিতরকার অনেক বিষয় নিয়ে কথা বললেন। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম তাঁর কথা শুনে। তারপর মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় দেখা হতো। কখনো কখনো বাংলাবাজারে নওরোজ কিতাবিস্তানে আসতেন। ইফতেখার রসুল জর্জের সঙ্গে বসে গল্প করতেন, চা খেতেন। সেখানে আমিও থাকতাম। এত বড় একজন লেখক এত আন্তরিক ভঙ্গিতে আমাদের সঙ্গে মিশতেন, কথা বলতেন, ভাবলে অবাক লাগে।

একদিন তাঁকে বললাম, ‘মুখর মাটি’ কবে বই হয়ে বেরোবে? আমি সেই বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। ধারাবাহিকভাবে পড়েছি। এখন একত্রে পড়ার অপেক্ষায় আছি। সেদিনই তিনি জানালেন ‘মুখর মাটি’র নাম বদলে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ করেছেন। অচিরেই মুক্তধারা থেকে বেরোবে। আমি সেই বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। মাস দুয়েক পর ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। আমি তখন সারা দিন গেন্ডারিয়ার বাসায় বসে লিখি। কোনো কোনো দিন বাংলাবাজারে যাই আড্ডা দিতে। কোনো কোনো দিন যাই ফরিদুর রেজা সাগরের খাবার-দাবার রেস্টুরেন্টে। কোনো কোনো দিন যাই শাহবাগের রেখায়নে। এক দুপুরে কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখি আবু ইসহাক দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে নীল মলাটে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’। আমি বিস্মিত। আবু ইসহাক এসেছেন আমার ফ্ল্যাটে! এ তো কল্পনারও অতীত। প্রথমে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘আজই বইটা বেরিয়েছে। মুক্তধারা তো ফরাশগঞ্জে। সেখান থেকে গেন্ডারিয়া কাছে। জর্জের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে বইয়ের প্রথম কপিটাই তোমাকে দিতে এলাম।’ দুই হাতে ইসহাক ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। গভীর আবেগে চোখে পানি এসেছিল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর