শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শেষ ব্যস্ততা ভোটের আয়োজনে

কেন্দ্রে কেন্দ্রে যাচ্ছে ব্যালট পেপার ও ভোটের বাক্স, নির্বাচন কমিশনের কঠোর মনিটরিং

গোলাম রাব্বানী ও মানিক মুনতাসির

শেষ ব্যস্ততা ভোটের আয়োজনে

গতকাল রাজধানীতে যানবাহনে তল্লাশি চালান সেনা সদস্যরা (বামে)। সিলেটের জেলা নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে ভোটের সরঞ্জাম কেন্দ্রের জন্য নেওয়া হচ্ছে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজনে শেষ ব্যস্ততা চলছে নির্বাচন কমিশনে। ভোট উৎসব পালনে প্রস্তুত প্রার্থী ও ভোটাররা। অপেক্ষা শুধু ভোট গ্রহণের। কাল ৩০ ডিসেম্বর রবিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে ২৯৯ আসনে। ব্যালট পেপারসহ প্রয়োজনীয় নির্বাচনসামগ্রী জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর থেকে কেন্দ্রে কেন্দ্রে যাবে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স। তবে কোনো সমস্যা হলে শেষ মুহূর্তে ব্যালট পেপার পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হচ্ছে হেলিকপ্টার। শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাহী এবং বিচারিক হাকিম নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। এ ছাড়া ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও গতকাল মাঠে নেমেছেন। ভোটের পরদিন পর্যন্ত তারা থাকবেন। ভোটের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে রয়েছেন। সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণে সবকিছু কঠোরভাবে মনিটরিং করছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য ইসিতে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। নির্বাচনে রয়েছে নিবন্ধিত ৩৯টি দল। ২৯৯ নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৮৬১ জন। রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ১ হাজার ৭৩৩ জন। স্বতন্ত্র ১২৮ জন। এবার ভোট কেন্দ্রের ভিতরে মোবাইল ফোন ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণারোপ করা হয়েছে। শুধু কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ইনচার্জ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন। কেউ ভোট দিতে মোবাইল ফোন নিয়ে গেলেও তা বন্ধ রেখে যেতে হবে। ঝুঁর্কিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেকিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে।

দেশবাসীর নজর এখন রবিবারের দিকে, দেশের সাড়ে ১০ কোটি ভোটার ওইদিন যাদের পক্ষে রায় দেবেন, তারাই গঠন করবে সরকার। আগামী পাঁচ বছর তাদের হাতেই ক্ষমতা। উৎসবমুখর পরিবেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রত্যাশা সবার। উৎসবমুখর ভোটের প্রত্যাশা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার। ভোটের প্রচার শেষে রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও সমর্থকদেও কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ভোট হবে ‘উৎসবমুখর’। ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়সহ সব ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবাইকে নির্ভয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ব্যাপকসংখ্যক দল ও সর্বাধিক প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। উৎসবমুখর ভোট হবে এটাই আশা।

১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের এ নির্বাচনে নিবন্ধিত সব দলই অংশ নিচ্ছে; রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। সব দলের সমান সুযোগ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, হামলা-সংঘাতের মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা গতকাল সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে। প্রতীক বরাদ্দের পর ১০ ডিসেম্বর সারা দেশে আনুষ্ঠানিক ভোটের প্রচার শুরু হয়েছিল। সে সুযোগ শেষ হয়েছে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টায়। তার আগে বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন প্রার্থীরা। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল গ্রাম-গঞ্জ-নগর-মহানগর-হাটবাজার-অলি-গলি রাজপথ।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। ভোটের দিন ২৪ ঘণ্টা নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জনসাধারণের মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকবে ২৮ ডিসেম্বর শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ১ জানুয়ারি মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে সংবাদপত্র বহনকারী গাড়িসহ জরুরি কাজে নিয়োজিত যেমন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিমানবন্দও, যাত্রী পরিবহন ইত্যাদি কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য যানবাহন চলাচলে নিষেধজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৭ লাখের মতো সদস্য, ভোট গ্রহণে নিয়োজিত ৭ লাখের মতো কর্মকর্তা এবং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকসহ প্রায় ১ লাখের মতো লোকবল মিলিয়ে ১৫ লাখ লোক নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত। ৩০ ডিসেম্বর ২৯৯ আসনে ভোট হবে। এক প্রার্থীর মৃত্যুতে গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোট হবে ২৭ জানুয়ারি। ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করেন সিইসি কে এম নূরুল হুদা। ১২ নভেম্বর পুনঃ তফসিল করা হয়।

এক নজরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট : রিটার্নিং অফিসার ৬৬ জন ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার ৫৮২ জন। ভোট কেন্দ্র ৪০ হাজার ১৮৩টি। ভোটকক্ষ ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২টি। ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ আর মহিলা ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন। রাজনৈতিক দল ৩৯টি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ২৯৯ নির্বাচনী এলাকায় ১ হাজার ৮৬১ জন। রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ১ হাজার ৭৩৩ জন। স্বতন্ত্র ১২৮ জন।

ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা : প্রিসাইডিং অফিসার ৪০ হাজার ১৮৩ জন। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন। পোলিং অফিসার ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন। পর্যবেক্ষক : দেশি ৮১টি প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৯০০ জন; বিদেশি ৩৮ জন (ফেমবোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েল্থ থেকে আমন্ত্রিত)। কূটনৈতিক বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন। দূতাবাস ও বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন।

ইভিএম : ৬টি আসনে ভোটার ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪ জন; কেন্দ্র ৮৪৫টি, ভোটকক্ষ ৫ হাজার ৪৫টি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ৪৮ জন। রংপুর-৩ ভোটার ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৭১ জন। খুলনা-২ ভোটার ২ লাখ ৯৪ হাজার ১১৬ জন। সাতক্ষীরা-২ ভোটার ৩ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৬ জন। ঢাকা-৬ ভোটার ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫ জন। ঢাকা-১৩ ভোটার ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৭৫ জন। চট্টগ্রাম-৯ ভোটার ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৩১ জন।

ভোট কেন্দ্রের ভিতরে মোবাইল ফোন ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণারোপ : ভোট কেন্দ্রের ভিতরে মোবাইল ফোন ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণারোপ করা হয়েছে। শুধু কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ইনচার্জ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন। কেউ ভোট দিতে মোবাইল ফোন নিয়ে গেলেও তা বন্ধ রেখে যেতে হবে। গতকাল সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এক ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, ভোট দিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়বে না। তবে ভোটারের এনআইডি নম্বর, ভোটার নম্বর বা স্মার্টকার্ড থাকলে দ্রুত ভোটার তালিকা থেকে নাম শনাক্তে সুবিধা হয়। সেইসঙ্গে আজকের মধ্যে মোবাইলের মাধ্যমে নিজের ভোট কেন্দ্র ও ভোটার নম্বর জানতে নির্দিষ্ট ‘কোড নম্বর’ জানিয়ে দেওয়া হবে। সচিব বলেন, ভোট কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসার ও দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ছাড়া কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবে না। তবে ভোটাররা চাইলে সঙ্গে মোবাইল ফোন বহন করতে পারবেন। ভোট কেন্দ্রের ভিতরে তা সুইচ অফ রাখতে হবে। ভোটাররা কোনোভাবেই বুথ ও কেন্দ্রে ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। ইসি সচিব জানান, ভোটের দিন ইসির অনুমোদন ছাড়া কোনো যান্ত্রিক যানবাহন চলবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি গাড়ি, সেবা সংস্থা যেমন ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্র পরিবাহী গাড়ি এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। ইসি সচিব বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ভোট দেওয়ার জন্য পোস্টাল ব্যালটের আবেদন করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসার বলতে পারবেন।

ফলাফল ঘোষণার প্রক্রিয়ার বিষয়ে ইসির অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বলেন, প্রতিটি ভোট কেন্দ্রেই ফলাফল ঘোষণা হবে। প্রিসাইডিং অফিসার ভোট গ্রহণ শেষে সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রেই ভোট গণনা করবেন। এ সময় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, প্রার্থীর এজেন্টরা উপস্থিত থাকতে পারবেন। ভোট গণনা শেষে প্রিসাইডিং অফিসার লিখিত ফলাফল সংশ্লিষ্টদের সরবরাহ করবেন। পরে এ ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ইসির ফোয়ারা প্রাঙ্গণে স্থাপিত মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে। এ চত্বরে ইসি ১০টি মনিটরের মাধ্যমে ফলাফল প্রদর্শন করবে। তিনি বলেন, ইভিএমের ভোট কেন্দ্রে স্মার্টকার্ড বাধ্যতামূলক নয়, তবে নিয়ে গেলে ভোটদান সহজ হবে।

এসএমএসের মাধ্যমে জানা যাবে ভোট কেন্দ্র ও ভোটার নম্বর : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তাদের ভোট কেন্দ্র ও ভোটার নম্বর জানতে পারবেন। নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে পাঠানো এসএমএস পূরণ করলে ফিরতি এসএমএসে এটি জানা যাবে। গতকাল ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, সারা দেশের ভোট কেন্দ্রের নাম জানানোর জন্য কমিশন থেকে আজ শনিবার ভোটারদের কাছে এসএমএস পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা একটি এসএমএস তৈরি করেছি। এসএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল যেভাবে এসএমএসের মাধ্যমে জানা যায়, সেভাবেই ভোটার নম্বর ও কেন্দ্র ভোটাররা জানতে পারবেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর