শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

কেন্দ্র পাহারা ও এজেন্ট ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে বিএনপি

মাহমুদ আজহার

ভোট কেন্দ্র পাহারা ও এজেন্ট দেওয়া নিয়ে শঙ্কায় ধানের শীষের প্রার্থীরা। নতুন করে দেশব্যাপী গ্রেফতার অভিযান বেড়ে যাওয়ায় বিএনপিসহ ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, যেভাবে নতুন করে পাড়া-মহল্লা, গ্রামেগঞ্জে গ্রেফতার আতঙ্ক শুরু হয়েছে, তাতে কেন্দ্র পাহারা দেওয়া এবং ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়বে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ হানা দিয়ে পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে। এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না রিটার্নিং কর্মকর্তারা। সবাই যেন আওয়ামী লীগকে জেতাতে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। নির্বাচনের ন্যূনতম সুষ্ঠু পরিবেশ নেই বলেও মনে করেন বিএনপির হাইকমান্ড।

বিএনপিসূত্রে জানা যায়, এজেন্ট নিয়োগে ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি। এজেন্ট নিয়োগে কৌশলী অবস্থানও নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে এসব নির্দেশনা প্রার্থীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে ৩০ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত পোলিং এজেন্টদের গ্রেফতার এড়ানোর জন্যও  নির্দেশনা রয়েছে। মামলা নেই এমন নেতা-কর্মীদের এজেন্ট দিতে বলা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেভাবে গ্রেফতার অভিযান চলছে তাতে কেন্দ্রে এজেন্ট রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়বে। পঞ্চগড়-১ আসনে গত তিন দিনে অন্তত অর্ধশত নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা এজেন্ট হিসেবে কাজ করবেন, বেছে বেছে তাদেরই ধরা হচ্ছে। এ নিয়ে আমি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছি। তিনি বিষয়টি দেখবেন বললেও বাস্তবতা কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। অবিলম্বে এ গ্রেফতার অভিযান বন্ধ হওয়া উচিত।’

১৭টি নির্দেশনা : ১. ভোট কেন্দ্রের প্রতি লাইনে/বুথে একজন করে ধানের শীষের এজেন্ট থাকবেন। ২. প্রতি বুথে একটি করে ব্যালট বাক্স বসানো হবে। সকাল ৮টায় ভোট শুরুর আগে বাক্সটি খালি আছে কিনা দেখবেন। ৩. এজেন্টরা ব্যালট বাক্সের নম্বরটি লিখে রাখবেন। ৪. প্রতি বুথে কতটি ভোট কাস্ট হচ্ছে হিসাব রাখবেন। একটি বইয়ে ১০০টি ব্যালট থাকে। কতটি বই গেল এবং সর্বশেষ বই থেকে কতটি ব্যালট পেপার গেল তা দেখে যার যার বুথে কাস্টিং ভোটের হিসাব লিখবেন। ৫. চূড়ান্ত ভোট গণনার সময় এক কেন্দ্রে ধানের শীষের একজন এজেন্ট থাকতে পারবেন। যিনি থাকবেন তার হাতে ব্যালট বাক্সের নম্বর ও কাস্টিং ভোটের হিসাব জমা না দিয়ে অন্যরা বেরিয়ে যাবেন না। ৬. গণনার সময় যিনি থাকবেন তিনি ব্যালট বাক্সের নম্বরগুলো মিলিয়ে নেবেন। নম্বর না মিললে বুঝতে হবে ভোটের বাক্স বদলে ফেলা হয়েছে। ৭. গণনার আগেই কাস্টিং ভোটের মোট হিসাবটা প্রিসাইডিং অফিসার থেকে নেবেন এবং নিজ হিসাবের সঙ্গে মিল আছে কিনা দেখবেন। ৮. গণনার পর সব মার্কার ভোট ও বাতিল ভোটগুলো যোগ করলে কাস্টিং ভোটের সমান হবে। বেশি হলে বুঝতে হবে বাইওে থেকে সিল মারা ব্যালট পেপার ঢোকানো হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রিসাইডিং অফিসারকে জানাতে হবে। কাউন্টিং ভোট কাস্টিং ভোটের চেয়ে কম হলে বুঝতে হবে কিছু ভোট গায়েব হয়েছে। দুয়েকটি মিস হলে সমস্যা নেই। বেশি হলে প্রিসাইডিং অফিসারকে জানাতে হবে। ৯. বাছাইয়ের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে ধানের শীষে সিল মারা ব্যালট অন্য বান্ডিলে যাচ্ছে কিনা। লক্ষ্য রাখতে হবে নৌকার বান্ডিলে অন্য প্রতীকের ব্যালট যাচ্ছে কিনা। ১০. ভোটের সময় কেউ ভোট কেন্দ্রে বার বার এসে জাল ভোট দিচ্ছে কিনা খেয়াল রাখবেন। অনিয়ম দেখলেই সহকারী/প্রিসাইডিং অফিসারকে জানাতে হবে। ১১. প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে নির্বাচনী এজেন্ট যারা থাকবেন তাদের এখন থেকে সাবধানে থাকতে বলুন। প্রয়োজনে তাদের কেন্দ্রে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আত্মগোপনে থাকার ব্যবস্থা করে দিন। ১২. ফলাফল বুঝে পাওয়ার আগে রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর করবেন না। ১৩. প্রিসাইডিং অফিসারের স্বাক্ষর ছাড়া রেজাল্ট শিট নেবেন না। ১৪. রেজাল্ট শিট ও ব্যালট পেপারের হিসাবের শিট ছাড়া কেন্দ্র থেকে বের হবেন না। ১৫. জোরপূর্বক বের করে দিলে সঙ্গে সঙ্গে রিটার্নিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার, ধানের শীষের/প্রার্থীর কেন্দ্রীয় এজেন্ট, মিডিয়া, পর্যবেক্ষক ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে যারা আছেন তাদের জানাবেন। ফোন নম্বরগুলো আগে থেকে সংগ্রহে রাখবেন। কল দেবেন ভয়েস রেকর্ড অন করেই। ১৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নম্বরগুলো ভোটের আগের দিন সন্ধ্যার পর পরিচিত একজন প্রিসাইডিং অফিসার থেকেও নেওয়া যাবে। ১৭. প্রতিটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে আরও একজন এজেন্ট থাকবেন যার হাতে প্রয়োজনীয় ফোন নম্বরগুলো থাকবে। বরিশাল-১ আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী জহির উদ্দিন স্বপন অভিযোগ করে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার শেষ রাতে যেভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আমার বাসায় হানা দিয়েছে তাতে আমি আমার জীবন নিয়ে শঙ্কিত। এক সপ্তাহ ধরে আমি বাসায় অবরুদ্ধ। আমার নিরাপত্তায় থাকা কয়েকজন নেতা-কর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে। আমি এখন ভোট কেন্দ্রে এজেন্টের চেয়ে নিজের জীবন নিয়েই শঙ্কিত।’ চাঁদপুর-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী ফরিদউদ্দিন মানিক বলেন, ‘চার দিন ধরে আমি গৃহবন্দী। আমাকে ঘর থেকেই বেরোতে দেওয়া হচ্ছে না। এজেন্টদের তালিকাও আমার কাছে। কিন্তু নেতা-কর্মীদেরও আসতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি কীভাবে এজেন্ট দেব!’

ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক সাজু অভিযোগ করেন, ‘ভোট কেন্দ্রে এজেন্ট দেওয়া নিয়ে আমি শঙ্কিত। আমার নির্বাচনী এলাকার পোলিং এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করছে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। তার পরও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ৩০ ডিসেম্বর নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ধানের শীষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

কুমিল্লা-৩ আসনে ৪০ এজেন্ট গ্রেফতারের অভিযোগ : কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী কে এম মুজিবুল হকের নির্বাচনী এজেন্টদের গণহারে গ্রেফতারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কে এম মুজিবুল হক অভিযোগ করেন, গত তিন দিনে ওই নির্বাচনী এলাকার দুটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে পুলিশ ৪০ জন এজেন্টকে গ্রেফতার করে। এজেন্টদের না পেয়ে তাদের পরিবারের সদস্যদের আটক করা হচ্ছে। এ ছাড়া আসন এলাকার মুরাদনগর ও বাঙ্গুরাবাজার থানার বিভিন্ন গ্রামে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি, হুমকি ও গ্রেফতারের কারণে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।

বরিশাল ৬টি আসনে এজেন্ট পাচ্ছে না বিএনপি : বরিশাল জেলার ৬টি আসনে এজেন্ট খুঁজে পাচ্ছে না বিএনপি। এ ৬টি আসনে ৮০৫টি কেন্দ্রের ৪ হাজার ৪৭টি কক্ষ। সে হিসেবে প্রতি কক্ষে একজন করে পোলিং এজেন্ট প্রয়োজন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্যান্য দল কিংবা জোটের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট চূড়ান্ত হয়েছে। কিন্তু জেলার ৬টি আসনের কোথাও পোলিং এজেন্ট পাচ্ছেন না বিশেষ করে বিএনপি তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীরা। যদিও ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থীদের দাবি তারা তিন স্তরে পোলিং এজেন্ট তালিকা চূড়ান্ত করেছেন। এদের মধ্যে কেউ আত্মগোপনে, কেউ কারাগারে, কেউ আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকলে সব কেন্দ্রে কিংবা কক্ষে পোলিং এজেন্ট দেওয়া সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা করেছেন বরিশাল-১ আসনে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী এম জহির উদ্দিন স্বপন।

রাজশাহীতে এজেন্ট নিয়ে আতঙ্কে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা : রাজশাহী-১ আসনে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী ব্যারিস্টার আমিনুল হক তিন দিন আগেই প্রচারণা স্থগিত করেছেন। তার দাবি, এলাকায় গেলে তার ওপর হামলা করা হচ্ছে। কর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিনি গণসংযোগ বন্ধ রেখেছেন। এখন এজেন্টদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি ও ভয়ভীতি দেখাচ্ছে পুলিশ। ভয়ে অনেকে এখন এজেন্ট হতে চাচ্ছেন না। ব্যারিস্টার আমিনুল হক অভিযোগ করেন, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হচ্ছে না। এখন এজেন্টদের গ্রেফতার শুরু করেছে পুলিশ।

রাজশাহী-৩ আসনে প্রার্থী শফিকুল হক মিলন অভিযোগ করেন, পুলিশ আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী মিলে তার পোলিং এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। নির্বাচনের দিন তারা যেন কেন্দ্রে না যায়, সেই ভয় দেখাচ্ছে। রাজশাহী-৪ আসনের প্রার্থী আবু হেনা গত এক সপ্তাহ এলাকায় যেতে পারছেন না। তার অভিযোগ, নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। পোলিং এজেন্ট হিসেবে যাদের নামের তালিকা করা হয়েছিল, তাদের আটক শুরু করেছে পুলিশ। রাজশাহী-৫ আসনের প্রার্থী নজরুল ইসলাম ম ল বলেন, গ্রেফতারের ভয়ে অনেকে পোলিং এজেন্ট হতে চাচ্ছেন না।

* রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন রাজশাহী ও বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক ও কুমিল্লা প্রতিনিধি।

সর্বশেষ খবর