রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শঙ্কা উত্তেজনার ভোট উৎসব আজ

গোলাম রাব্বানী

শঙ্কা উত্তেজনার ভোট উৎসব আজ

রাজধানীতে নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে গতকাল কড়া প্রহরা (বামে)। ব্যালট পেপার সরবরাহে ব্যস্ত কর্মীরা -রোহেত রাজীব

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট উৎসব আজ। শঙ্কা ও উত্তেজনা থাকলেও এ উৎসব পালনে প্রস্তুত প্রার্থী ও ভোটাররা। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে ২৯৯ আসনে। ব্যালট পেপারসহ প্রয়োজনীয় নির্বাচনসামগ্রী ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। এবার ৬টি আসনে ভোট হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। বাকি ২৯৩ আসনে সনাতন পদ্ধতির ব্যালটে ভোট নেওয়া হবে।

ভোটকে ঘিরে দেশজুড়েই টানটান উত্তেজনা আছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোট আয়োজনে সব প্রস্তুতি নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শান্তিপূর্ণ ভোটের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। অবাধ-সুষ্ঠু ভোট গ্রহণে সবকিছু কঠোরভাবে মনিটরিং করছে নির্বাচন কমিশন। এজন্য ইসিতে নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। আজ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

নির্বাচন কেন্দ্রে সহিংসতা ও অনিয়ম কঠোরভাবে দমনে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। গতকাল বিকালে নির্বাচনের সর্বশেষ প্রস্তুতি জানাতে নির্বাচন কমিশন ভবনে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি পুলিশকে এ নির্দেশ দেন। নির্বাচনী প্রতিযোগিতা যেন সহিংসতায় রূপ না নেয় সেজন্য অংশগ্রহণকারী দল ও প্রার্থীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, এর মধ্যে কিছু নির্বাচনী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত হয়েছে। এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন তিনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রয়েছে নিবন্ধিত ৩৯ দল। ভোটের লড়াইয়ে আছেন ২৯৯ নির্বাচনী এলাকায় ১ হাজার ৮৬১ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ১ হাজার ৭৩৩ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ১২৮ জন। প্রার্র্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৬০ (নৌকা ২৭২), বিএনপির ২১৯ (ধানের শীষ ২৮২), জাতীয় পার্টি ১৭৫ (মহাজোট ২৫) এবং নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ২৯৮ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের। অধিকাংশ নিবন্ধিত দলের বর্জন-সহিংসতার মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার পাঁচ বছর পর এবারের নির্বাচনে সব দলকেই পাচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ১০ কোটি ৪২ লাখ ভোটারের এ নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এবারে ভোট কেন্দ্রের ভিতরে মোবাইল ফোন ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণারোপ করা হয়েছে। শুধু কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও কেন্দ্রের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের ইনচার্জ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন। কেউ ভোট দিতে মোবাইল ফোন নিয়ে গেলেও তা বন্ধ করে যেতে হবে। ঝুঁর্কিপূর্ণ ভোট কেন্দ্রে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে চেকিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হবে। এ ছাড়া ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে রয়েছেন। ভোটের পরদিন পর্যন্ত তারা থাকবেন।

সব দলের সমান সুযোগ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ, হামলা-সংঘাতের মধ্যে এ নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়। প্রতীক বরাদ্দের পর ১০ ডিসেম্বর সারা দেশে আনুষ্ঠানিক ভোটের প্রচার শুরু হয়েছিল। বৃহস্পতিবার গভীর রাত পর্যন্ত ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন প্রার্থীরা। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল গ্রাম-গঞ্জ-নগর-মহানগর-হাটবাজার-অলি-গলি রাজপথ। উৎসবমুখর ভোটের প্রত্যাশা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার। ভোটের প্রচার শেষে রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও সমর্থকদের কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ‘সংখ্যালঘু’ সম্প্রদায়সহ সব ভোটারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সবাইকে নির্ভয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে সিইসি বলেন, ব্যাপকসংখ্যক দল ও সর্বাধিক প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। উৎসবমুখর ভোট নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৭ লাখের মতো সদস্য, ৭ লাখের মতো ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক-পর্যবেক্ষক মিলিয়ে ১৫ লাখ লোক নির্বাচনী কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন বলে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছেন।

এক নজরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট : রিটার্নিং অফিসার ৬৬ জন ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার ৫৮২ জন। ভোটার ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৬ হাজার ৮২৩ জন। এর মধ্যে ৫ কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৬২০ জন পুরুষ এবং ৫ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ২০৩ জন নারী। ৪০ হাজার ৫১টি ভোট কেন্দ্রের ২ লাখ ৫ হাজার ৬৯১টি ভোটকক্ষে ভোট গ্রহণ করা হবে। রাজনৈতিক দল ৩৯টি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী (২৯৯ নির্বাচনী এলাকায়) ১ হাজার ৮৬১ জন। রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ১ হাজার ৭৩৩ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী ১২৮ জন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী : ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত ফোর্সের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ৮ হাজার। এর মধ্যে পুলিশ ১ লাখ ২১ হাজার, আনসার ৪ লাখ ৪৬ হাজার, গ্রামপুলিশ ৪১ হাজার। সেনাবাহিনী (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) ৪১৪ প্লাটুন (৩৮৯ উপজেলায়), নৌবাহিনী (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) ৪৮ প্লাটুন (১৮ উপজেলায়), কোস্টগার্ড (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) ৪২ প্লাটুন (১২ উপজেলায়), বিজিবি (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) ৯৮৩ প্লাটুন, র‌্যাব (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) ৬০০ প্লাটুন, মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সংখ্যা র‌্যাবসহ প্রায় ২০০ প্লাটুন (প্রায় ৬৫ হাজার জন)। তা ছাড়া সারা দেশে জেলা ও মেট্রোপলিটন পুলিশের টহল দল নিয়োজিত রয়েছে।

ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা : প্রিসাইডিং অফিসার ৪০ হাজার ১৮৩ জন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন, পোলিং অফিসার ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন। পর্যবেক্ষক : দেশি ৮১টি প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৯০০ জন, বিদেশি ৩৮ জন (ফেমবোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত)। কূটনৈতিক বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন, দূতাবাস ও বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন।

ইভিএম : ৬টি আসনে ভোটার ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৫৪ জন; কেন্দ্র ৮৪৫টি, ভোটকক্ষ ৫ হাজার ৪৫টি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ৪৮ জন। রংপুর-৩ ভোটার ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৭১ জন। খুলনা-২ ভোটার ২ লাখ ৯৪ হাজার ১১৬ জন। সাতক্ষীরা-২ ভোটার ৩ লাখ ৫৬ হাজার ২৪৬ জন। ঢাকা-৬ ভোটার ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩১৫ জন। ঢাকা-১৩ ভোটার ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭৭৫ জন। চট্টগ্রাম-৯ ভোটার ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৩১ জন। ভোট চলবে আজ সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। একজন প্রার্থীর মৃত্যু হওয়ায় ৩০০ আসনের মধ্যে আজ ভোট গ্রহণ করা হবে ২৯৯ আসনে। বাকি থাকা গাইবান্ধা-৩ আসনে ২৭ জানুয়ারি ভোটের তারিখ নির্ধারণ করেছে ইসি।

ফল ঘোষণা : কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণনা শেষে প্রিসাইডিং অফিসাররা লিখিত ফলাফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা ইসিতে পাঠাবেন। ঢাকায় নির্বাচন ভবনের ফোয়ারা প্রাঙ্গণে বিশেষ মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে।

বিধিনিষেধ : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত কোনো ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল বা শোভাযাত্রা করা যাবে না। ভোটের দিন ২৪ ঘণ্টা নির্বাচনী এলাকায় ট্যাক্সিক্যাব, বেবিট্যাক্সি/অটোরিকশা, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, লঞ্চ, ইজিবাইক, ইঞ্জিনবোট ও স্পিডবোট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জনসাধারণের মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে ২৮ ডিসেম্বর শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে ১ জানুয়ারি মঙ্গলবার মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে সংবাদপত্র বহনকারী গাড়িসহ জরুরি কাজে নিয়োজিত যেমন অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক, টেলিযোগাযোগ, বিমানবন্দর যাত্রী পরিবহন ইত্যাদি কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য যানবাহন চলাচলে নিষেধজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ইসি। ভোট দিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন পড়বে না। তবে ভোটারের এনআইডি নম্বর, ভোটার নম্বর বা স্মার্টকার্ড সঙ্গে থাকলে ভোটার তালিকা থেকে নাম বের করতে সুবিধা হবে।

আওয়ামী লীগের ২৬০, বিএনপির ২৫৭ প্রার্থী : সব প্রক্রিয়া শেষে সংসদ নির্বাচনে ভোটের ব্যালটে থাকছে ১ হাজার ৮৬১ প্রার্থীর নাম; তাদের মধ্যে দলীয় প্রার্থী ১৭৩৩ জন; বাকি ১২৮ জন স্বতন্ত্র। আদালতের নির্দেশনার পর ধানের শীষের প্রার্থী ১৫ জন কমলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী বেড়েছে ২৯ জন। আওয়ামী লীগ ও শরিকদের মিলিয়ে নৌকার ২৭২ জন প্রার্থী চূড়ান্ত লড়াইয়ে আছেন। তাদের বিপরীতে ধানের শীষ প্রতীকে বিএনপি ও শরিকদের প্রার্থী সংখ্যা ২৮২। সবচেয়ে বেশি ২৯৮ জন প্রার্থী রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকে।

কোন দলের কত প্রার্থী : এলডিপি ৮ (ধানের শীষ ৪), জেপি ১১ (মহাজোট ২), সাম্যবাদী দল ২, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৮ (ধানের শীষ ৪), সিপিবি ৭৪, আওয়ামী লীগ ২৬০ (নৌকা ২৭২), বিএনপি ২৫৭ (ধানের শীষ ২৮২), গণতন্ত্রী পার্টি ৬, ন্যাপ ৯, জাতীয় পার্টি ১৭৫ (মহাজোট ২৫), বিকল্পধারা ২৬ (নৌকা ৩), ওয়ার্কার্স পার্টি ৮ (নৌকা ৫), জাসদ ১১ (নৌকা ৩),  জেএসডি ১৯ (ধানের শীষ ৪), জাকের পার্টি ৯০, বাসদ ৪৪, বিজেপি ৩ (ধানের শীষ ১), তরিকত ফেডারেশন ১৭ (নৌকা ১), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ২৪, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৪৮, এনপিপি ৭৯, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ৮ (ধানের শীষ ৩), গণফোরাম ২৮ (ধানের শীষ ৭), গণফ্রন্ট ১৩, পিডিপি ১৪, বাংলাদেশ ন্যাপ ৩, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ১১, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ১৮, কল্যাণ পার্টি ২ (ধানের শীষ ১), ইসলামী ঐক্যজোট ২৫, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ৫, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ২৯৮, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ২৫, জাগপা ৪, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি ২৮, খেলাফত মজলিস ১২ (ধানের শীষ ২), বিএমএল ১, মুক্তিজোট ২, বিএনএফ ৫৭ জন। স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন ১২৮ জন।

 

সর্বশেষ খবর