শুক্রবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঘুরে বেড়াচ্ছে ইয়াবা গডফাদাররা

মৃত্যুভয়ে পালিয়ে আছে চুনোপুঁটিরা

নিজামুল হক বিপুল, টেকনাফ থেকে

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইয়াবা ব্যবসার উর্বর ভূমি টেকনাফ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এখানকার ঘরে ঘরে বিস্তার লাভ করেছে ইয়াবা ব্যবসা। এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের হাত ধরে মরণব্যাধি এ মাদকের বিস্তার ঘটেছে। এদের কেউ কেউ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের গডফাদার। আবার বড় একটা অংশ সরাসরি ব্যবসার সঙ্গেই জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এবং বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় কক্সবাজার জেলার যে ১ হাজার ১৫১ জন ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে তার মধ্যে ৯ শতাধিক ব্যবসায়ী হচ্ছেন নাফতীরের সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফের। গত বছরের প্রথম দিকে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের কারণে এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বড় অংশই আত্মগোপনে। মাঝেমধ্যে দু-একজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও অন্যদের কোনো সন্ধানই পাচ্ছে না পুলিশ প্রশাসন। কিন্তু যারা গডফাদার, যারা ইয়াবার বড় ব্যবসায়ী তারা এলাকায় দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর চুুনাপুঁটিরা পালিয়েছেন। স্থানীয়দের প্রশ্ন, টেকনাফের এত ইয়াবা ব্যবসায়ী গেলেন কই?

ছোট ও মাঝারিরা পালিয়ে বেড়ালেও ব্যতিক্রম শুধু শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ ইয়াবা ব্যবসায়ী গা ঢাকা দিলেও টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে যে ৭৩ জনের নাম রয়েছে তালিকার প্রথম দিকে, তার বেশির ভাগ এখনো প্রকাশ্যে আছেন। তাদের অনেকে আবার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও তারা এখনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছেন, গত বছরের ৪ মে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে টেকনাফে এখন পর্যন্ত যত ইয়াবা ব্যবসায়ী ধরা পড়েছেন কিংবা ক্রসফায়ারে বা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন তার বেশির ভাগই ছোট ও মাঝারি গোছের ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও জনপ্রনিধি তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাদের টিকিটিও ছুঁতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের বাসাবাড়িতেও পুলিশ এ পর্যন্ত কোনো অভিযান বা তল্লাশি চালায়নি। আত্মসমর্পণের বিষয়েও তাদের কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে হাজারো প্রশ্ন স্থানীয়দের মাঝে।

অবশ্য টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলছেন, এ অভিযোগ সঠিক নয়। যারা ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। তার দাবি, যারা বন্দুকযুদ্ধে মারা যাচ্ছেন তারা কেউই চুনোপুঁটি নন। পুলিশের কাছে সব অপরাধীই সমান।

সরেজমিন টেকনাফ উপজেলা সদর ও আশপাশের জালিয়ারপাড়া, নাজিরপুর, বড় হাবিরপাড়া, ছোট হাবিরপাড়া, মৌলভীপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় অনেকের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, টেকনাফের ইয়াবা ব্যবসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন সরকারদলীয় সদ্য সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। তার আশ্রয়-প্রশ্রয়েই গত ১০-১২ বছরে ইয়াবা ব্যবসার বিস্তার ঘটেছে টেকনাফের গ্রামে-গঞ্জে, আনাচে-কানাচে। তার আপন ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন নির্বিঘ্নে ইয়াবার ব্যবসা চালিয়েছেন। তিনি কখনই কাউকে বাধা দেননি কিংবা লাগাম টেনে ধরেননি। ফলে তারা বেপরোয়াভাবে ইয়াবার বিস্তার ঘটিয়েছেন।

টেকনাফ সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া গ্রামের এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাবেক এমপি বদি নিজে সরাসরি ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এ কথা যেমন ঠিক, তেমন তিনি তো তার ভাই-বোন, ভাগনে, ভাতিজা যারা ইয়াবা ব্যবসা চালিয়েছেন বছরের পর বছর তাদের বাধাও দেননি। বদির আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা ব্যবসা করেছেন। এ দায় কোনোভাবেই বদি এড়াতে পারেন না। এ কারণেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার করা মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকায় তার নাম সবার শীর্ষে।

শুধু বদি ও তার পরিবারের সদস্যরাই নন, টেকনাফের শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় নাম রয়েছে টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, তার ছেলে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহজান মিয়া, তার আরেক ছেলে মোহাম্মদ ইলিয়াছ (যে নিজেকে সরকারের এক মন্ত্রীর ছেলের বন্ধু হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ান), জাফর আহমদের ভাই বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মৌলানা আজিজ উদ্দিন, জাফর আহমদের বড় জামাতা ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর ছেলে মাহবুব মোর্শেদ ও ছোট ছেলে রাশেদ মোহাম্মদ আলী, টেকনাফ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা রফিক উদ্দিন, বদির ছোট ভাই টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মৌলভী মুজিবুর রহমান, বদির বড় বোনের জামাই পুলিশের সাবেক পরিদর্শক (ওসি) আবদুর রহমান, সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা যুবলীগের সভাপতি নূর হোসেন, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস কে আনোয়ার, ইয়াবা ব্যবসার প্রথম দিকের হোতা সাইফুল করিম (বর্তমানে দেশের বাইরে, গত বছর অভিযান শুরুর পরপরই দেশ ছাড়েন)। এদের সবার নাম শীর্ষ ৭৩ জনের তালিকায় রয়েছে।

স্থানীয় সূত্রগুলো বলছেন, শীর্ষ তালিকার এই মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা দূরে থাক, মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত তাদের বাসাবাড়িতে অভিযানই চালায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। উল্টো তারা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় থাকার পরও কীভাবে তারা ঘুরে বেড়ান- এটিই এখন স্থানীয়দের কাছে ‘অপার রহস্য!’

এরা ছাড়াও শীর্ষ ৭৩ জনের তালিকায় নাম আছে মৌলভীপাড়ার মো. একরাম ও তার ভাই আবদুর রহমান, হ্নীলার নির্মল সেন, হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল হোসেন, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য জামাল হোসেন ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল হুদার। সূত্র জানান, শেষের তিনজনের মধ্যে বাবুল মেম্বার মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর প্রথম দিকে ইয়াবাসহ ধরা পড়লে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে ছয় মাসের কারাদ  দেয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, তার কারাদ  হওয়ার পরও ইউনিয়ন পরিষদে তার সদস্যপদ এখন পর্যন্ত শূন্য হয়নি। আর জামাল ও নুরুল হুদা মেম্বার আত্মসমর্পণের জন্য এখন পুলিশ হেফাজতে কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে রয়েছেন। শীর্ষ তালিকার আরও দুই ব্যবসায়ী সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোদার বিলের আলী আহমদের দুই ছেলে আবদুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানও আত্মসমর্পণের জন্য কক্সবাজার পুলিশ লাইনসে রয়েছেন। আর শীর্ষ তালিকায় থাকা একমাত্র সংখ্যালঘু ব্যক্তি নির্মল সেন এখন পর্যন্ত পুলিশের নজর এড়িয়ে যাচ্ছেন। তাকে ধরা দূরের কথা, তার বাড়িতে কোনো অভিযান পর্যন্ত চালায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর