জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সর্বশেষ বৈঠক হয় বুধবার। বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধি বলতে উপস্থিত ছিলেন শুধু ড. আবদুল মঈন খান। এর কিছুদিন আগেও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মানববন্ধনে বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে কেবল তাকেই দেখা যায়। জানা যায়, রাগে-ক্ষোভে-অভিমানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেন দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। পরে স্থায়ী কমিটির গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও ড. আবদুল মঈন খানকে যুক্ত করা হয় স্টিয়ারিং কমিটিতে। কিন্তু ড. মঈন খানকে ঐক্যফ্রন্টের কর্মসূচিতে দেখা গেলেও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এখনো স্টিয়ারিং কমিটির কোনো বৈঠকে যোগ দেননি।
জানা যায়, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বও ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গেলেও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা শুধু ভোটেই মনোযোগী ছিলেন। ফ্রন্টের অনেক প্রার্থী বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসংবলিত লিফলেটও তারা বিতরণ করেননি। এ নিয়ে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মধ্যে অনেক প্রশ্ন ছিল। কোথাও কোথাও বিএনপি নেতা-কর্মীরা ফ্রন্ট নেতাদের সঙ্গে প্রচারণায় নামেননি। নির্বাচনোত্তর অবস্থায় এই ফ্রন্টের কোনো যৌক্তিকতা আছে কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন দলের অধিকাংশ নেতা-কর্মীর।
এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি, ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সবে একটি জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে। ভোট ডাকাতির নির্বাচন আর মামলা নিয়েই ঐক্যফ্রন্টের নেতারা এখন ব্যস্ত। তার পরও দেশবাসী যদি মনে করেন, এখন আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই, তাহলে থাকবে না। এ নিয়ে কোনো ভুল বোঝাবুঝি থাকবে কেন? তবে ২৪ ফেব্রুয়ারি গণশুনানি পর্যন্ত ঐক্যফ্রন্ট থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।’ বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতারা বলছেন, বিএনপি যদি এককভাবে নির্বাচনে যেত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি হতো না। অন্তত একটি শক্তিশালী বিরোধী দলে থাকত বিএনপি। কিন্তু ঐক্যফ্রন্ট গঠনের ফলে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ দাবি-দাওয়া নিয়ে কোনো আন্দোলনই করা যায়নি। রাজপথের শক্ত কোনো কর্মসূচি না দেওয়ার পেছনে ঐক্যফ্রন্টকেই দায়ী করছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা। তারা আরও বলছেন, ঐক্যফ্রন্ট কখনই কোনো রাজপথের গণতান্ত্রিক শক্ত কর্মসূচির পক্ষে ছিল না। হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর গণতান্ত্রিক কর্মসূচির ঘোরতর বিরোধী ছিল ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাদামাটা কোনো কর্মসূচি দিয়ে দাবি আদায় করা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন দলটির নেতারা। ঐক্যফ্রন্টে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই বলে দাবি করেছেন গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক, স্টিয়ারিং কমিটির আরেক সদস্য মোস্তফা মহসীন মন্টু। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ কয়েকজন নেতা দেশের বাইরে ছিলেন। এ অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের দুটি কর্মসূচি ছিল। সেখানে নেতারা কম উপস্থিত ছিলেন। তবে এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোনো অবকাশ নেই।’সূত্রমতে, বিএনপির সঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয় নির্বাচনের আগেই। জামায়াতের ২২ প্রার্থীর হাতে ধানের শীষ প্রতীক তুলে দেওয়ায় ড. কামাল হোসেন খেপে যান। এ নিয়ে তিনি গণমাধ্যমে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আগে জানতে পারলে তিনি ঐক্যফ্রন্টেই থাকতেন না। বিএনপির প্রতি তার রাগ ও ক্ষোভের প্রশমন করেন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে ড. কামালকে বুঝিয়ে ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্বে থাকার অনুরোধ করেন তারা। এরপর তিনি এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। বিএনপির সঙ্গে সর্বশেষ টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় নির্বাচনের পর। গণফোরামের দুই প্রার্থী বিজয়ী হলে তারা ড. কামালকে বোঝাতে সক্ষম হন, ঐক্যফ্রন্টের সংসদে যাওয়া উচিত। তাদের দলীয় ফোরামেও এ নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়। পরে বিএনপি তাদের বুঝিয়ে বাগড়া দিলে গণফোরাম দলীয়ভাবে দুই সংসদ সদস্যকে সংসদে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। এ নিয়ে দলের অবস্থানও পরিষ্কার করা হয়। গণফোরামের দুই নেতা অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে সংসদে যেতে আগ্রহী। যে কোনো অধিবেশনে গণফোরামের দুই নেতা সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও মুকাব্বির খান সংসদে যোগদান করতে পারেন। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক কী পর্যায়ে তা আমি বলতে পারব না। এ নিয়ে কাজ করছেন আমাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে রয়েছেন। শিগগিরই দেশে ফিরবেন। তিনি ঐক্যফ্রন্টেরও মুখপাত্র। আমি ২০-দলীয় জোট নিয়ে কাজ করি। এটুকুই বলব, ২০ দল এখনো অটুট আছে।’ সূত্রমতে, উপজেলা ভোটে যাওয়া নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এমনকি ২০-দলীয় জোটেও এ নিয়ে বিএনপি কোনো বক্তব্য পরিষ্কার করেনি। তবে বিএনপির কিছু জনপ্রিয় প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান (পুরুষ ও মহিলা) পদে লড়ছেন। দলীয় পদ থেকে ইস্তফা দিয়েও তারা ভোটের মাঠে থাকতে প্রস্তুত। কিন্তু কেন্দ্র থেকে শুধু দলের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি আর কোনো ভোটে যাবে না। কেউ ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করলে কী হবে, তা পরিষ্কার করেনি দলটি। এ নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের অন্য শরিকরা বলছেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের কোনো আলাপ হয়নি। তার পরও সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে এ নিয়ে তাদের কোনো আলোচনা না হলেও উপজেলা নির্বাচনে গণফোরাম কোনো প্রার্থী দেবে না। সূত্র আরও জানান, ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো নেতা বেগম জিয়ার মুক্তি নিয়েও কথা বলতে নারাজ। তারা বলছেন, এটা আইনি বিষয়। আইনিভাবেই এর সুরাহা হবে। আদালতের বিষয়ে কম কথা বলাই ভালো। বিএনপির পক্ষ থেকে এ নিয়ে আপত্তি তোলা হলে অবশ্য এখন প্রায় সব নেতাই সভাসমাবেশে বেগম জিয়ার মুক্তি দাবি করেন। কিন্তু তারা এ দাবিতে ফ্রন্টভিত্তিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে।