সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

শ্রমবাজারের সংকট গভীরে

ক্রমেই সংকুচিত শ্রমবাজার, কিছুতেই হচ্ছে না একক কোনো পদ্ধতি, কার্যকর ভূমিকা নেই বায়রার, প্রয়োজন সমন্বিত অনলাইন সিস্টেম

জুলকার নাইন

শ্রমবাজারের সংকট গভীরে

ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসা বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সংকটের কারণ অনেক গভীরে। সাধারণভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে জনশক্তি প্রেরণ কার্যক্রম চালানোই আজকের পরিস্থিতির কারণ। দেশের প্রায় সব কর্মকান্ড অনলাইনে ডিজিটাল পদ্ধতিতে চললেও সম্পূর্ণ অ্যানালগভাবে চলছে জনশক্তি কার্যক্রম। ফলে সুযোগ নিচ্ছে দালাল ও সুবিধাভোগী চক্র। নিয়ন্ত্রণ থাকছে না অভিবাসন ব্যয়ের। প্রবাসে গিয়ে বাংলাদেশিরা কী পরিস্থিতিতে পড়ছেন তাও থাকছে না পর্যবেক্ষণে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতির পরিবর্তনে সমন্বিত অনলাইন সিস্টেম চালু করতে হবে। জানা যায়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবে জনশক্তি প্রেরণের গতি প্রায় থমকে গেছে। সৌদি আরবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তান থেকে শ্রমিক নেওয়ার কোটা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া যুদ্ধবিগ্রহের কারণে সৌদি আরবে এমনিতেই শ্রমিক নেওয়ার পরিমাণ কমেছে। সেখানে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের বিষয়ে আগ্রহ দেখানো হচ্ছে। কিন্তু নির্যাতনের অভিযোগও কম নয়। বাংলাদেশের অপর শ্রমবাজার আরব আমিরাতের বাজার দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ। এ ছাড়া সেখানে তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না কাউকেই। আরেক বড় বাজার মালয়েশিয়া সরকার পরিবর্তনের পর বন্ধ করে রেখেছে শ্রমিক নেওয়া। বড় শ্রমবাজারগুলো বন্ধ থাকার পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের বিষয়েও তেমন কোনো উদ্যোগ কার্যকর হয়নি। শ্রমবাজারের এসব সংকটের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নির্যাতিত নিপীড়িত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের কর্মীরা প্রায়শই অবৈধ হয়ে পড়ছেন। ট্যুরিস্ট বা ভিজিট ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসায় বাংলাদেশিদের বিদেশে গিয়ে অবস্থানের ঘটনাও বাড়ছে। বাংলাদেশে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণের কথা বলা হলেও সেটা মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিয়োগকর্তারা বিনা পয়সায় কর্মী নেওয়ার পর শুনছেন তাদের ৫-৬ লাখ টাকা ব্যয়ের কথা। অবশ্য বিভিন্ন দেশের বাজার বন্ধ হওয়ার পর ভিসা ট্রেডিং রেট এখন লাগাম ছাড়া। সৌদি ভিসাই ৭-৮ লাখ টাকায় বিক্রি করছে বিভিন্ন অসাধু এজেন্সি ও ব্যক্তি পর্যায়ে ভিসা কেনা-বেচা করা প্রবাসীরা।

বিপুল অবৈধ শ্রমিকে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমবাজার : বাংলাদেশ থেকে ট্যুরিস্ট বা ভিজিট ভিসায় বিভিন্ন দেশে গিয়ে অবস্থান করে কাজ করা শ্রমিকরা যেমন অবৈধ হচ্ছেন, তেমনি বিভিন্ন সময়ে বৈধ উপায়ে যাওয়া শ্রমিকরা হয়ে যাচ্ছেন অবৈধ। বিভিন্ন দেশে নিয়োগ কর্তারা শ্রমিকদের পারমিটের মেয়াদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিচ্ছেন না। আবার অনেক শ্রমিক নিজেরাই বছর শেষে সেসব দেশের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করছে না। আবার অনেকে অধিক আয়ের লোভে নির্ধারিত নিয়োগকর্তার কর্মস্থল ত্যাগ করে অন্যত্র অবৈধভাবে কাজে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে বৈধ পাসপোর্টগুলো অবৈধ শ্রমিকদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। বিপুল সংখ্যক অবৈধ কর্মীর অবস্থানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের শ্রমবাজার। আর যেসব এজেন্সির পাঠানো শ্রমিকরা বিদেশে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ছেন বা পরিস্থিতি তৈরি করছেন তাদেরও নেই কোনো মাথাব্যথা। বাংলাদেশ থেকে এসব বিষয় পর্যবেক্ষণেরও কোনো ব্যবস্থা নেই। পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই শ্রমিকদের বিদেশযাত্রার সময় ব্যয় করা অর্থের বিষয়েও।

কিছুতেই হচ্ছে না একক কোনো সিস্টেম : জনশক্তি প্রেরণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের একক পদ্ধতি হতে পারে সমন্বিত অনলাইন সিস্টেম। ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য জনশক্তি প্রেরক দেশ এ পদ্ধতির বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশেও কয়েক বছর ধরেই এ বিষয়ে প্রস্তাবনা উত্থাপিত হলেও কোনো মন্ত্রী বা সচিবের আমলে যথাযথ সদিচ্ছা দেখিয়ে এই সিস্টেম বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। সম্প্রতি একটি কানাডিয়ান কোম্পানির পক্ষ থেকে বিনামূল্যে সফটওয়্যার দিয়ে একটি সিস্টেম বাস্তবায়নের প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

সমন্বিত অনলাইন সিস্টেম : ইন্টিগ্রেটেড (সমন্বিত) অনলাইন সিস্টেমে বিদেশ গমনেচ্ছু সবার সাধারণ রেজিস্ট্রেশন থাকতে পারে। যে কেউ যে এজেন্সি থেকেই বিদেশ যেতে চাইবেন তাকেই এই রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমেই যেতে হবে। বিদেশ গমনেচ্ছু তার অভিবাসন ব্যয়ের অর্থ পরিশোধ করবেন তার নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিপরীতে কোনো নির্ধারিত ব্যাংকিং চ্যানেলে। ব্যাংকের বাইরে কোনো দালাল বা এজেন্সির কাছেই কোনো ধরনের লেনদেনের সুযোগ থাকবে না। ব্যাংকে টাকা জমার রসিদ নিয়েই হবে মেডিকেল চেকআপ। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেডিকেল চেকআপের রিপোর্টও জমা থাকবে অনলাইনে। মেডিকেল রিপোর্ট ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়োগকর্তা যখন কাউকে বাছাই করবে তখনই ব্যাংক থেকে টাকা চলে যাবে এজেন্সির অ্যাকাউন্টে। আর কেউ নিয়োগ না পেলে সে নিজেই তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে নিজের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিতে পারবে।

ট্রেড বডিতে এরা কারা : জনশক্তি রপ্তানির উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার থাকার কথা জনশক্তি প্রেরক এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানি পরিস্থিতির মান উন্নয়নে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারছে না সংগঠনটি। বায়রা নেতৃত্বে থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কখনো কোনো ধরনের জনশক্তি রপ্তানি করেছেন কি না তা জানেন না সংগঠনেরই কোনো সদস্য। এর আগে দীর্ঘ সময় নেতৃত্ব দেওয়া আরেক সভাপতি জনশক্তি রপ্তানি করলেও বিদেশে গিয়ে তিনি পড়তেন ভাষা সমস্যায়। ফলে বিদেশে নীতিনির্ধারণী ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তাকে পড়তে হয়েছে নানা বিড়ম্বনায়। নিতে হয়েছে দোভাষী। আর খোলামেলা আলাপ আলোচনা ছাড়া তেমন কার্যকর পদক্ষেপ যথেষ্ট কঠিন। আবার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তার পদে ক্ষণস্থায়ী বিভিন্ন ব্যক্তির উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে প্রায়শই। কয়েকদিনের জন্য দায়িত্ব পাওয়া সরকারি কর্মকর্তারা নিজের মেয়াদে কোনোভাবেই জনশক্তি রপ্তানির দুর্নীতি বা অনিয়ম দূর করতে সাহসী কোনো পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হচ্ছেন না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর