শিরোনাম
শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নুসরাত হত্যায় ১৬ জনের ফাঁসি

ছয় মাসের মধ্যে রায়, প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা জরিমানা, আসামিদের ভূমিকা উল্লেখ, ১ সপ্তাহের মধ্যে আপিল

আরাফাত মুন্না ও জমির বেগ্, ফেনী থেকে

নুসরাত হত্যায় ১৬ জনের ফাঁসি

রায়ের পর কাঁদতে কাঁদতে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে বের হন অধ্যক্ষ সিরাজ (বাঁয়ে)। স্বস্তি প্রকাশ করে আবেগাপ্লুত নুসরাতের পরিবার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

চাঞ্চল্যকর নুসরাত হত্যা মামলায় প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১৬ আসামির সবাইকেই মৃত্যুদন্ড দিয়েছে আদালত। অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করায় ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ছয় মাসের মধ্যে গতকাল ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ জনাকীর্ণ আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করেছে আদালত। জরিমানার এই অর্থ আদায় করে নুসরাতের পিতা-মাতাকে প্রদানের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রায়ে। ১৭৩ পৃষ্ঠার এ রায়ে হত্যাকান্ডে আসামিদের কার কী ভূমিকা ছিল তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে নুসরাতের পরিবার, রাষ্ট্র ও বাদী পক্ষের আইনজীবীরা। ফেনীর সর্বস্তরের মানুষ এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। রায়ের পর শহরে আনন্দ মিছিল করতেও দেখা গেছে। তবে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো- সোনাগাজী মাদ্রাসার বরখাস্তকৃত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. রুহুল আমিন, মাদ্রাসার প্রভাষক আফছার উদ্দিন, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, হাফেজ আবদুল কাদের, ছাত্র নূর উদ্দিন, ইফতেখার উদ্দিন রানা, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, মো. শামীম, সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, আবদুর রহিম শরীফ, মহিউদ্দিন শাকিল, ইমরান হোসেন মামুন, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন্নাহার মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম। রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল সকাল থেকে ফেনীর আদালত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়। আদালত এলাকায় প্রবেশমুখে সবাইকে নিরাপত্তা তল্লাশি করা হয়। সকাল পৌনে ১১টার দিকে ফেনী জেলা কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয় আসামিদের। ১১টা ৩ মিনিটে এজলাসে ওঠেন বিচারক। মূল রায় ঘোষণার আগে বিচারক উপস্থিত সবার উদ্দেশে বক্তব্য দেন। এ সময় বিচারক বলেন, সবার সহযোগিতায় আমরা দ্রুত মামলাটি শেষ করতে সক্ষম হয়েছি। এ জন্য আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বিচারক বলেন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ার কারণেই নুসরাত হত্যার ঘটনাটি বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে। মিডিয়া ধৈর্য ধরে মামলাটি পর্যবেক্ষণ করেছে। আইনজীবীরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করায় মামলাটি দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন বিচারক। এরপর বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। ১৭৩ পৃষ্ঠার রায়ের সমাপনী অংশ এজলাসে পাঠ করেন বিচারক। রায়ে আসামিদের সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কান্নায় ভেঙে পড়েন আদালতে উপস্থিত নুসরাতের বাবা এ কে এম মুসা। রায় ঘোষণার পর বিচারক উঠে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে কাঁদতে থাকেন আসামিরাও। এ সময় তারা আইনজীবী ও গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করতে থাকেন।

রায়ে নুসরাত হত্যায় আসামিদের ব্যক্তিগত ভূমিকা : নুসরাত হত্যার ঘটনায় ১৬ আসামির প্রত্যেকের ব্যক্তিগত ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে রায়ে। এতে বলা হয়, সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেন। নূর উদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করে ও তা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা নির্বিঘ্নে ঘটানোর জন্য মাদ্রাসার বাইরে পাহারায় থাকেন। শাহাদাত হোসেন শামীম হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী কেরোসিন তেল সংগ্রহ করেন, নুসরাতকে হাত-পা বেঁধে ছাদে ফেলে মুখ ও মাথা চেপে ধরে কেরোসিন ঢেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। মাকসুদ আলম হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা প্রদান করেন এবং ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেন। সাইফুর রহমান মো. জোবায়ের হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী নুসরাতের ওড়না দুই ভাগে ছিঁড়ে এক ভাগ দিয়ে পা পেঁচিয়ে কেরোসিন দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন দেন।

জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ হত্যার পরিকল্পনা করেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী আগুন দেওয়ার আগে কেরোসিন ঢালেন। হাফেজ আবদুল কাদের হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্বিঘ্নে আগুন দেওয়ার জন্য মাদ্রাসার গেটের বাইরে পাহারায় থাকেন। আবছার উদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন এবং মাদ্রাসার বাইরে পাহারায় থাকেন। কামরুন নাহার মণি হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী বোরকা ও হাতমোজা সংগ্রহ করেন এবং নুসরাতকে সাইক্লোন শেল্টারের ফ্লোরে শুইয়ে বুক চেপে অগ্নিকা  নির্বিঘ্নে করেন।

উম্মে সুলতানা পপি হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যার উদ্দেশ্যে নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে আসেন। আবদুর রহিম শরীফ ঘটনার সময় মাদ্রাসার ফটকে পাহারায় ছিলেন। পরে তিনি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালান। ইফতেখার উদ্দিন রানা মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে পাহারায় ছিলেন। ইমরান হোসেন ওরফে মামুন মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে পাহারায় ছিলেন। মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন শেল্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন। কেউ যেন ওই সময় ছাদে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ। মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় অংশ নেন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া ঘটনার পর আসামিদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন। মহিউদ্দিন শাকিল হত্যার পরিকল্পনা করেন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন এবং সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। এ ছাড়া পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনার সময় সাইক্লোন শেল্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ নুসরাতের ভাইয়ের : রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে নুসরাতের বাবা মুছা মিয়া ও ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, আল্লাহতায়ালার দরবারে আমরা শুকরিয়া আদায় করছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমরা শুকরিয়া আদায় করছি, সন্তুষ্ট আছি। আর কোনো বাবার মেয়েকে ও ভাইয়ের বোনকে যেন এভাবে জীবন দিতে না হয়।

সন্তুষ্ট বাদীপক্ষের আইনজীবী : নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বাদী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাদীপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উচ্চ আদালতে যেন এ রায় কার্যকর থাকে, তেমন প্রস্তুতি নেব আমরা। মামলার রায়সহ কাগজপত্র এক সপ্তাহের মধ্যে অ্যাটর্নি জেনারেলের দফতরে পাঠানো হবে।

আপিল করবে আসামিপক্ষ : নুসরাত হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ড হওয়া সব আসামিই এ রায়ের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আপিল করবে বলে জানিয়েছে আসামি পক্ষের আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু। রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আদালত রায় দিয়েছে। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে এক সপ্তাহের মধ্যে উচ্চ আদালতে আপিল করব।

ঘটনাক্রম : ২৭ মার্চ, নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন হয়রানির অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে, অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেফতার। ৬ এপ্রিল, পরীক্ষার হল থেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন। ৮ এপ্রিল, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে নুসরাত, মামলা দায়ের। ১০ এপ্রিল, নুসরাতের মৃত্যু, মামলা পিবিআইতে স্থানান্তর। ২৯ মে, ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল। ৩০ মে, হাকিম আদালত থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর। ১০ জুন, অভিযোগপত্র আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল, গ্রেফতার পাঁচজনকে অব্যাহতি। ২০ জুন, ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন। ২৭ জুন, বাদীর সাক্ষ্য নেওয়ার মধ্য দিয়ে শুনানি শুরু। ৯ সেপ্টেম্বর, সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ। ৩০ সেপ্টেম্বর, রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ। ২৪ অক্টোবর, রায়ে ১৬ আসামির সবার মৃত্যুদন্ড।

নুসরাত হত্যার মামলটি তদন্ত প্রথমে করছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন। কিন্তু ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকান্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর। পিবিআইর পরিদর্শক শাহ আলম এজহারভুক্ত আট আসামির সঙ্গে আরও আটজনকে যুক্ত করে ১৬ জনকে আসামি করে গত ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তার পরের মাসে ২০ জুন ১৬ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬ আসামির বিচার। ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।

অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে আলাদা মামলা হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর