ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজেটে না আনতে পারায় সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঋণের চড়া সুদে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সীমাহীন। ব্যাংক ঋণের সুদের এত উচ্চহার পৃথিবীর কোথাও নেই। সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে মাঝারি ও ক্ষুদ্র সব পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের করুণ অবস্থা। অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংক, এমন কি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও সরকারি ব্যাংক বাদে হাতেগোনা দু-একটি বেসরকারি ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দিচ্ছে। বাকিরা আমলেই নিচ্ছে না। এ নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, স্টেক হোল্ডারদের তারা এখন বেসরকারি ব্যাংকে লেনদেন বন্ধ করে শুধু সরকারি ব্যাংকে লেনদেন (ঋণ) করার পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চক্রবৃদ্ধি সুদের চাপে অনেক ব্যবসায়ীরই পথে বসার উপক্রম হয়েছে। ব্যাংক খাতে যেমন স্বেচ্ছা ঋেণখেলাপি রয়েছে ঠিক তেমন অতিরিক্ত সুুদের চক্করে পড়েও ঋণখেলাপি হয়েছেন এমন নজিরও বিদ্যমান। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উৎকর্ষ সাধনের জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার বাস্তবায়নে হার্ডলাইনে রয়েছে সরকার। তাই তিনি ব্যাংকগুলোর প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন করতে না পারলে ব্যবসা বন্ধ করে দিন। অক্টোবরের পর এখন পর্যন্ত যেসব ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেনি সেসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবছে সরকার। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থে আমরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের সুদ হার নিয়ে কথা বলে আসছি। এত বেশি উচ্চসুদ আর কোথাও নেই। সরকারও এটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকগুলো কথা শুনছেই না। আমরা এখন সবাইকে বলছি সরকারি ব্যাংকে মার্জ হওয়ার জন্য। এ ছাড়া তো বাঁচার কোনো উপায় নেই। আমরা আসলে এই পর্যায়ে এসে প্রচ রকমের হতাশ। সরকারের হাতে আর কোনো করণীয় আছে কিনা-তা আমার জানা নেই।
এদিকে গত সপ্তাহে একনেক সভায় একাধিক মন্ত্রী এ বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভও প্রকাশ করা হয়। এমনকি বারবার নির্দেশনা দেওয়া সত্ত্বেও যারা তা বাস্তবায়ন করছে না তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিরও প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আর সুদ হার নিয়ে এক ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত এর সমাধান হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চরম ক্ষতির মুখে পড়বে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের নির্দেশনাগুলো ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মেনে চলা উচিত বলে তারা মনে করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ব্যাংক ঋণের এক অঙ্কের সুদের বাস্তবায়ন নিয়ে হাজারো চিঠি চালাচালি, বহু নির্দেশনা আর অসংখ্যবার বৈঠক করেও এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে অক্টোবর-২০১৯ পর্যন্ত আলটিমেটাম দেওয়া হলেও এখনো বেশিরভাগই বেসরকারি ব্যাংক এটা বাস্তবায়ন করেনি। তবে অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, সবগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বেসরকারি কয়েকটি ব্যাংক সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। এদিকে চলতি মাসের শেষের দিকে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। সেখানে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এ ছাড়া যারা এখনো সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন করেনি তাদেরকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিলি সব ব্যাংক, ব্যাংকার, ব্যাংকের মালিক, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত কয়েক বছর ধরে বারবার বৈঠক করলেও সন্তোষজনক ফলাফল আসেনি। এমন কি সব তফসিলি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ বেঁধে দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, সেটাও মানেনি অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংক। তবে দু-একটি ব্যাংক কোনো কোনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে বলে জানা গেছে।এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটা একটা জটিল ইস্যু কেননা যারা ব্যবসায়ী তারাই তো আবার ব্যাংকের মালিক। ফলে সুদ হার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এটাও একটা অন্তরায়। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোর অতি মুনাফার একটা ব্যাপার তো আছেই। পাশাপাশি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যাংকগুলো যেভাবে ব্যবসা করছে সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো-এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই উচিত যথাযথভাবে রেগুলেশনগুলো কার্যকর করা। এতে প্রয়োজনে আরও কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। জানা গেছে, সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার নিয়ে জাতীয় সংসদেও তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে একাধিকবার। আর ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সাবেক ও বর্তমান একাধিক মন্ত্রী ও এমপি এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগও করেছেন। এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা থেকে শিল্পপতিরাও অর্থমন্ত্রীর কাছে বিস্তর লিখিত অভিযোগ করেছেন। তাদের অভিযোগ সিঙ্গেল ডিজিট সুদের হারের আড়ালে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের শুভঙ্করের ফাঁকি দিচ্ছে। এদিকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার উচ্চ হারের খেলাপি ঋণ এই দুটি বিষয়ই আমাদের অর্থনীতিতে দীর্ঘকাল ধরে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। ব্যাংক ঋণের সুদ একটি গ্রহণযোগ্য ও ব্যবসাবান্ধব পর্যায়ে নিয়ে আসতে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। সে জন্য কার্যকর উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ নজরদারি করা হচ্ছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে। যেসব ব্যাংকের এমডি এখনই ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে অনীহা প্রকাশ করেছেন, তাদের সঙ্গে উচ্চপর্যায় থেকে কথা বলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটা অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককেও অবহিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংক মালিকদের সংগঠন (বিএবির) পক্ষ থেকেও ব্যাংকের এমডিদের ওপর ঋণের সুদ কমাতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।