মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নির্বাচন কমিশনে কর্তৃত্বের লড়াই

নিয়োগ আর্থিক ব্যয়সহ সব ধরনের ক্ষমতা নিয়ে সিইসি সচিব একদিকে চার কমিশনার অন্যদিকে

গোলাম রাব্বানী

নির্বাচন কমিশনে কর্তৃত্বের লড়াই

নিয়োগ, আর্থিক ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের ক্ষমতা নিয়ে নির্বাচন কমিশনে চলছে কর্তৃত্বের লড়াই। চার নির্বাচন কমিশনার ও সচিবের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। সচিবের সঙ্গে রয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। শুধু প্রশিক্ষণসংক্রান্ত ব্যয় ছাড়া অন্য কোনো আর্থিক বিষয়ে জানানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন চার নির্বাচন কমিশনার। বাকি প্রায় সব ক্ষেত্রে একক কর্তৃত্ব দেখাচ্ছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। যদিও সচিব বলছেন, আইন অনুযায়ী নির্বাচন ছাড়া অন্য বিষয়ে কমিশনকে জানানোর প্রয়োজন নেই। অবশ্য সদ্যসমাপ্ত নিয়োগ পরীক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা দেওয়া হলেও তার কোনো হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ উঠেছে, এ অর্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একক অনুমোদনে সচিবালয় থেকে দেওয়া হয়।

নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গতকালও পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ও ইসির সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ইসি সচিবালয়ে সে¦চ্ছাচারিতা চলে আসছে। ফলে অভ্যন্তরীণ অনিয়মে ইসির কার্যক্রম প্রশ্নের সম্মুখীন। সচিব মো. আলমগীর বলছেন, নির্বাচন কমিশনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। নিয়োগের বিষয়ে আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি। নির্বাচন কমিশনে পাল্টাপাল্টি অবস্থান ও দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে গত রবিবার। এদিন ইসি সচিবালয়ের একক কর্তৃত্ব ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে চারজন নির্বাচন কমিশনার প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে আন-অফিশিয়াল নোট (ইউও) দিয়েছেন। পাশাপাশি ইসির সিনিয়র সচিবের ওপরও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নোটে বলা হয়, সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ওপর নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ অনুপস্থিত। তারা শুধু প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সচিবের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। কমিশনের নিয়ন্ত্রণের কোনো মেকানিজম বা সুযোগ থাকছে না। তারা বলেন, সচিবালয়ের এমন কর্তৃত্ব সংবিধান, আরপিও ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

‘অনিয়মে সবকিছু প্রশ্নবিদ্ধ’ : অভ্যন্তরীণ অনিয়মের কারণে নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা চলে আসছে, যা সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালি বিধিমালা সমর্থন করে না। অনেক ক্ষেত্রে সচিবালয়ের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই দায় বহন করতে হয়। এই অনভিপ্রেত অবস্থার অবসানের জন্য নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত বিষয়ে সংবিধান, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন ও নির্বাচন কমিশন কার্যপ্রণালি বিধিমালা কঠোরভাবে পরিপালন করা আবশ্যক। নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয়ের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। গতকাল বিকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে ব্রিফিংকালে তিনি এ অভিযোগ করেন।

কমিশন সচিবালয়ে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ তুলে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘কমিশন সচিবালয়ের সাম্প্রতিক কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় ১৩৫ জন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে আমি চিঠি দিয়ে বিশদভাবে জানতে চাই, কিছু প্রশ্নের জবাব চাই। জবাবে জানানো হয়, হাতের লেখায় অমিল বা পরিচয়পত্রে অমিলের কারণে মৌখিক পরীক্ষার সময় ওই ১৩৫ জনকে বহিষ্কার করা হয়। প্রতারণার দায়ে তাদের মৌখিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য দেখানো হয়েছে। কারও কারও কাছ থেকে লিখিত স্বীকারোক্তি নেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।’ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র যাচাইয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদকে ৪ কোটি ৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে এই কমিশনার বলেন, ‘এ অর্থ প্রধান নির্বাচন কমিশনার অনুমোদন করলেও কতজন পরীক্ষককে কীভাবে এ টাকা দেওয়া হয় তার কোনো হিসাব নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। নিয়োগ কমিটির সদস্যও এ বিষয়ে অবহিত নন। কমিশন সচিবালয় পরীক্ষা সম্পর্কে কিছুই জানে না। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের ধরনের বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ।’

মাহবুব তালুকদার আরও জানান, ‘১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় কমিশন সচিবালয় ওই নিয়োগ পরীক্ষা ও অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে কমিশনকে কোনো পর্যায়েই অবহিত করেনি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনাররা জানতে চাইলে জবাবে কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব জানান, নিয়োগ বা এ-সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তার বক্তব্য সমর্থন করেন। স্বাভাবিক কারণেই নির্বাচন কমিশনাররা ২৪ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে একটি ইউও নোট পাঠিয়েছেন। তারা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাজের বিষয়ে কমিশনের এখতিয়ার সম্পর্কে অবহিত হতে চেয়েছেন।’

‘নির্বাচন ছাড়া অন্য বিষয়ে কমিশনকে জানানোর প্রয়োজন নেই’ : গতকাল নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর। স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগের বিষয়ে তিনি শুধু নির্বাচনসংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে পুরো নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করার বাধ্যবাধকতার কথা জানান। তিনি বলেন, প্রশাসনিক হেড সচিব, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ সিইসি। নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয় পুরো কমিশন থেকে অনুমোদন নিতে হবে। পুরো ইসি সচিবালয়েরও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেটা কীভাবে? সরাসরি নয়, উনারা যদি বলেন সচিব এ তথ্যটা দেন, তাহলে আমি দিতে বাধ্য। এ নিয়োগ কীভাবে হয়েছে সমস্ত কাগজপত্র দেখান, দেখাতে হবে।

কর্মচারী নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়টি নির্বাচন কমিশনারদের ‘অবগত’ করার বিষয় নয় উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন, শতভাগ আইনসম্মতভাবে ও স্বচ্ছভাবে কাজ হয়েছে। চার নির্বাচন কমিশনারকে না জানিয়ে কাজ করা আইনসম্মত হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ‘এটা হানড্রেড পারসেন্ট আইনসম্মত। সংবিধান, আইন, বিধি ও নিয়মকানুন ফলো করে করা হয়েছে। এ নিয়োগে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এটা প্রথম নিয়োগ নয়, প্রতিবারই একইভাবে নিয়োগ হয়েছে। কখনো কমিশনে যায়নি বিষয়টি।’ বিষয়টি তো কমিশনারদের কাছে যাওয়ারই কথা নয়; বাইপাস হলো কীভাবে? প্রশ্ন রাখেন সচিব।

আইন-বিধি তুলে ধরে ইসি সচিব বলেন, ‘মাননীয় কমিশনারবৃন্দ যেমন বলেছেন যে, কমিশনকে বাইপাস করে দেওয়া হয়েছে এটা। তাহলে উত্তর দিতে পারলাম- এটা কমিশনে যাওয়ার বিষয় নয়। আমরা আইনে দেখিয়ে দিলাম, এটা কমিশনের কাছে যায় না।’ স্বাধীন ইসি সচিবালয় আইনের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে তিনি জানান, ইসির সার্বিক নিয়ন্ত্রণ সিইসির কাছে ন্যস্ত থাকবে এবং সচিব ইসি সচিবালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব দেখবেন। আইনের পুরোটাই পড়তে হবে। সিইসি যদি প্রয়োজন মনে করেন, কোনো কিছু জানানোর দরকার তাহলে উনিই কমিশনকে জানাবেন। সচিব জানানোর কিছু নেই।

এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘কমিশনে কোনো দ্বন্দ্ব আছে বলে আমার জানা নেই। আমি সচিব হিসেবে সেটা ফিল করি না। এটা নির্বাচন কমিশনার মহোদয়রা কেন বলেছেন তারাই ভালো বলতে পারবেন। আমি তো ডিটেইল বলে দিলাম।’ ইউও নোটের ব্যাখ্যা প্রস্তুত করার বিষয়ে সচিব বলেন, ‘সিইসির কাছে উনারা দিয়েছেন। সিইসি মহোদয় আমাকে বলেছেন এ বিষয়ে আইন-কানুন যা আছে সব নিয়ে এ নিয়োগের বিষয়ে স্ট্যাটাস পেপারসহ আমাদের কাছে জমা দেন। সিইসি মহোদয় যদি প্রয়োজন মনে করেন কমিশনার মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করবেন, আলোচনা করবেন।’

চার নির্বাচন কমিশনারের অভিযোগ ভিত্তিহীন কিনা- জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘উনাদের বিবেচনায় যেটা ভালো মনে করেছেন, বলেছেন। নিয়োগ নিয়ে এটা তো প্রথম প্র্যাকটিস নয়, প্রতিটি নিয়োগই এভাবে হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর